কৃষককে বাঁচাই বাঁচবে কৃষি বাঁচবো আমরা

মানিকগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র রায়
করোনাকালিন সময়ে ও বর্ষা পরবর্তী মানিকগঞ্জ এর কৃষকগণ মহামারী ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করে সরকারি ঘোষণা মোতাবেক ‘বিনাযুদ্ধে দেব না সূঁচাগ্র মেদেনী’-এই শ্লোগানকে ধারণ করে, প্রতি ইঞ্চি জমির শতভাগ ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় শীতকালিন সবজি, গোল আলু, পেঁয়াজ,কাঁচা মরিচ চাষ করেন। চলতি শীতকালে ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, দেশী লাউ, মূলা, শীম, গাজর, গোল আলু, লালশাক, পালংশাক, শসাসহ আরো নানান জাতের সবজি মানিকগঞ্জ সদর, সিংগাইর, হরিরামপুর, ঘিওর, সাটুরিয়া, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বসতবাড়িতে, মাঠে ও ক্ষেতে, নিজস্ব প্রয়োজনে ও বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেন কৃষকরা। বর্ষায় পলি পড়ায় জমির ্উরর্বতাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলনও ব্যাপক হয়েছে।
পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয় ঘিওর, হরিরামপুর, শিবালয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠসমূহে। কাঁচা মরিচের অধিক দাম ছিল। পেঁয়াজের দাম গত বছর অধিক হওয়ায় এ বছর ব্যাপক চাষ হয়েছে। মরিচ উত্তোলন এখন শুরু হয়নি তবে পেঁয়াজের ডাঁটা (মুরিকাটা) বাজারে পাওয়া যায়।

সরকারি প্রণোদনা ও নিজস্ব উদ্যোগে এই সবজি চাষ বর্তমানে তাদের জন্য বোঝা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ব্যাপক সবজি একই সময় উৎপাদন হওয়ায় বাজারে সবজির চাহিদার তুলনায় দিগুণ বা তিন গুণ উপস্থিতি হচ্ছে। ফলে সবজি দামও ব্যাপকভাবে কমেছে। তাই তো দেখা গেছে, মানিকগঞ্জে বড় সাইজের ফুল কপি জোড়া ১০ টাকা, দেশী লাউ একটি ১০ থেকে ২০ টাকা, বেগুন কেজি ১০ থেকে ১৫, বাঁধাকপি ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। সবজির দাম কমে যাওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন না; কোন কোনক্ষেত্রে তাদের উৎপাদন খরচও উঠেনি!


এই বিষয়ে কথা হলো বেউথা বাজারের সবজি বিক্রেতা ও নবগ্রাম ইউনিয়নের চরবেংরুই গ্রামের কৃষক মোঃ ঈসমাইল (৬৫) এর সাথে। তিনি বলেন, ‘কিভাবে কৃষি করবো। আমি বর্ষার শেষে অনেক কষ্ট ও যতœ করে ৪০০০টি ফুলকপি উৎপাদন করলাম এখন বাজরে এনে ভ্যান ভাড়ার উঠতে চায় না, গরুকেই খাওয়ানো বেশি লাভ। বৌ ছেলেরা বললো এ বছর বন্যা হয়েছে সবাই ফুলকপি করবে। তাই অন্যকিছু করার তাগিদ দিলেও আমি ফুলকপি করলাম, ধরা খেলাম।’ বেংরুই গ্রামের আরেক সবজি চাষী আব্দুল বারেক বলেন, ‘দেড়বিঘা জমিতে ফুল কপি, ৫০ শতাংশ জমিতে টমেটো, আধবিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছি। প্রথমদিকে ভালো দাম পেয়েছি এখন বেগুনের দাম নাই, ছিড়লেও ক্ষতি না ছিড়লেও ক্ষতি। কারণ গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাই ছিঁড়তে হয়। তাই উভয় সংকটে পড়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেড়বিঘা জমিতে ফুলকপি উৎপাদনে ৩০ হাজারের মতো খরচ হয়েছে। ১০ হাজার টাকার মতো সবজি বিক্রি করেছি। সবকিছু হিসেবে করে দেখেছি যে, সবজি চাষ করে আমি লোকসানের মুখে পড়েছি।’ দেখা গেছে, সার, কীটনাশক, সেচ, জমিভাড়া বা নিজস্ব, চাষ, শ্রম ও অন্যান্য খরচ দিয়ে যে সবজি উৎপাদন করেছেন কৃষকরা তা বাজারজাতকরণ, পরিবহন ও শ্রম দিয়ে যে মূল্য পাওয়া যায় তা তাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। সারাদেশের চিত্র একই। কৃষকরা সবাই হতাশ। কৃষি করে লাভবান না হওয়ায় তাদের এই হতাশার মূল কারণ।

কৃষক পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, সকলে এক সাথে সবজি রোপণের কারণে একই সময় সকল সবজি বিক্রির উপযোগি হয়েছে। তাই দাম কমে গেছে। সবজি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষকরা এ সবজিগুলো পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বিক্রি করতে পারতো। তাতে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। আবার ভোক্তারা তাদের চাহিদা মাফিক ন্যায়সঙ্গত দামে সবজি কিনতে পারতো। তাই এলাকায় সবজি সংরক্ষণের মতো একটি সংরক্ষণাগার করার দাবি জানান কৃষকরা। কৃষি ও কৃষকের সাথে কাজ করে এরকম কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত সংরক্ষণাগার ও পর্যায়ক্রমিক সবজি উৎপাদনের শ্রেণি বিভাজন করা বা কৃষক যখন কোন জমিতে যাই লাগাবে তা কয়েকদিন অন্তর অন্তর লাগালে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে এবং দামও সহনীয় মাত্রায় থাকবে। ক্রেতাÑভোক্তার উভয়েই লাভবান থাকবে।

কৃষকেরা কৃষিতে তাদের শ্রম ও বিনিয়োগের বিনিময়ে লাভবান হতে চান। কৃষিতে লাভবান না হলে তাঁরা ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হবেন না। ফলশ্রুতিতে কৃষিতে নেমে আসবে বিশাল এক বিপর্যয়। দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই কৃষকরা যাতে কৃষিতে লাভবান হন, তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য লাভ করেন সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। কৃষরা তাদের কৃষিপণ্য যাতে সংরক্ষণ করতে পারেন তাই এলাকাভিত্তিক সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে সর্বাগ্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে; পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে পারেন। কারণ কৃষক বিপন্ন হলে বিপন্ন হবে কৃষি। আর কৃষি যদি না বাঁচে আমরা কেউ বাঁচতে পারবো না।

happy wheels 2

Comments