লাবণীর মত সকলের স্লোগান হোক ‘আর নয় বাল্যবিয়ে’

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, ইচ্ছা থাকলে মানুষ অনক অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। আর এজন্য প্রয়োজন চেষ্টা ও অধ্যবসায়। কথাগুলো বলছিলেন ¯œাতকে পড়–য়া শিক্ষার্থী লাবণী আক্তার। পারিবারিক দারিদ্রতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লাবণী আক্তার আজ অনেকটা সফলতা পেয়েছেন।

নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম লাবণী আক্তারের (২০)। পরিবারের ৬ ভাই-বোনের (৪ বোন ২ ভাই) মধ্যে লাবণী চতুর্থ। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, লাবণীসহ বাকি ভাই-বোনেরা লেখাপড়া করছে। পেশায় কৃষক পিতার বাড়িভিটাসহ মোট জমির পরিমাণ ৫০ শতাংশ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতার কৃষি কাজ ও কৃষি শ্রমিকের কাজ করে যে আয় হয় তা দিয়েই ৬ সদস্যের পরিবার অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করে। পারিবারিক অভাব অনটনের দরুণ লাবণী আক্তার নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার বাবা তার বিয়ে (বাল্যবিয়ে) ঠিক করেন। কিন্তু লাবণী এ বিয়েতে রাজি হয়নি। সে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পণ করে। গ্রামের সমবয়সী মেয়েদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে শপথ নেয় যে, তারা কেউ বাল্যবিয়ে করবে না।

লাবণী স্থানীয় বাজার থেকে কয়েকটি হাসঁ-মুরগি ও কবুতর কিনে পালন শুরু করে। হাসঁ-মুরগি ও কবুতর পালন করে প্রতিমাসে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে নিজের পড়াশুনায় খরচ চালাতে থাকে। পড়াশুনার জন্য বাবার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়ার প্রয়োজন হয় না তার। এভাবে লাবণী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বর্তমানে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে স্নাতকে পড়ছে। এ বিষয়ে লাবণী আক্তার বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। ইচ্ছা থাকলে মানুষ অনক অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে। আর এজন্য প্রয়োজন চেষ্টা ও অধ্যবসায়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে লাবণী পড়াশুনার পাশাপাশি গ্রামের সমবয়সী আরও পাঁচজন মেয়েকে সাথে নিয়ে নেত্রকোনা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ব্লক প্রিন্ট, সেলাই ও শোপিজ তৈরির উপর ছয় মাস মেয়াদী দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর লাবণী প্রথমে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় পোষাক ও শোপিজের জিনিস তৈরি করেন। তার হাতের কাজ দেখে (সেলাই ও শোপিজ) এলাকার পরিচিত নারীরা নিজেদের জন্য এবং তাদের সন্তানদের জন্য পোষাকসহ বিভিন্ন শোপিজ তৈরির ফরমায়েস দিতে থাকে। লাবণীও গ্রাহকদের ফরমায়েস অনুযায়ী জামা-কাপড় ও শোপিজ তৈরি করে বিক্রি করতে থাকে। একাজ থেকে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে তার নিজের পড়াশুনা খরচ ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটে যায়।

এভাবে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে এবং অনেক কষ্ট সত্ত্বেও লাবণী তার পড়াশুনা চালিয়ে যায়। সে বর্তমানে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অর্নাস তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। তার ছোটকাল থেকে বেড়ে ওঠা পাঁচজন বান্ধবীর সকলেই কেউ অনার্স আবার কেউবা মাষ্টার্সে পড়ছে। লাবণী নিজেই শুধু পড়াশুনা করেনা, গ্রামের অন্য মেয়েদেরও পড়াশুনা করতে উৎসাহিত করে। গ্রাম থেকে বাল্যবিয়ে দূরীকরণ, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, গর্ভবতী মা, প্রসূতি মা এবং নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও যুব মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে গ্রামের কিশোরী ও সমবয়সী মেয়েদের নিয়ে গড়ে তুলেন ‘অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন’ নামে একটি সংগঠন। গ্রামের কিশোর-কিশোরী, যুব ও নারীদের সুবিধার্থে গড়ে তুলেন একটি ‘তথ্য কেন্দ্র’। তথ্য কেন্দ্রে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বিরোধী, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, গর্ভবতী মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য, জৈব কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজনসহ বিভিন্ন ধরণের প্রকাশনা সংরক্ষণ, হাতের তৈরি শোপিজ, গ্রামীণ সাংস্কৃতিক উপকরণ সংরক্ষণ করেন। প্রতিদিন সংগঠনের সদস্য ও গ্রামের সকলের জ্ঞানার্জনের জন্য তথ্য কেন্দ্রটি উন্মূক্ত রাখা হয়। তথ্য কেন্দ্রে সমাজের উন্নয়নে অন্তরায় বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতিগুলো লাবণী নিজে এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে নিয়মিত আলোচনার পাশাপাশি সকল সদস্য ও অভিভাবকদেরকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও যৌতুক বিরোধী শপথ গ্রহণ করানো হয়। লাবণীসহ সংগঠনের সকল সদস্যদের মূল স্লোগান এখন- ‘আর নয় বাল্যবিয়ে, সমাজে ভালোভাবে বাঁচাতে হলে লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হতে হবে।’ লাবণী গ্রামের সকলকে যেকোন ধরণের বিপদে পড়লে তথ্য কেন্দ্রে এসে সদস্যদের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানে ফোন করে সহযোগিতা চাওয়ার পরামর্শ দেন।

লাবণী শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবেন না, গ্রামের অন্য সব মেয়েদের নিয়েও তার অনেক ভাবনা। বাল্যবিয়ে রোধে সংগঠনের সকলকে নিয়ে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে, নিজ চেষ্টায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে গ্রামের সচেতন গণ্যমাণ্য ব্যাক্তিদের সহযোগিতা নেন। এভাবে গ্রামের সচেতন মহলের সহযোগিতা নিয়ে সে এ যাবতকাল পর্যন্ত নিজ গ্রামে ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের ৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। লাবণী সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধে বিভিন্ন ধরণের প্রচারণা ও উদ্যোগ (লিফলেট/ব্রসিউর/পাম্পলেট বিতরণ ও আলোচনা সভা/মানববন্ধন) নেয়ার পাশাপশি গ্রামের দরিদ্র কিশোর-কিশোরীদের বিনামূল্যে লেখাপড়ায় (প্রাইভেট পড়া) সহযোগিতা ও হাতের কাজ শিখতে সহযোগিতা করেন। সে ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রচারণা (শিক্ষামূলক ক্লাশ) ও শিক্ষার্থীদের শপথ করান। ছোট বাচ্চাদের সাথে তার জীবনী, বেগম রোকেয়ার জীবনী, বিভিন্ন লেখক ও নিজের মায়ের জীবনের গল্প বলে তাদেরকে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন।

লাবণী সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের ৪৫ জন নারী শিক্ষার্থী ও গ্রামের নারীদের সাথে ৯ ডিসেম্বর/২০ বেগম রোকেয়া দিবসে রোকেয়া’র জীবনী (জন্ম ও নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়া’র অবদান) নিয়ে আলোচনা করে নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার মতে, ‘বেগম রোকেয়া’র জন্য আজ আমরা বাঙালি মেয়েরা শিক্ষার আলো দেখছি, নারীরা লেখাপড়া শিখে দেশে-বিদেশে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরণের করছে। বেগম রোকেয়া দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে লাবণী প্রচারণা অনুষ্ঠানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশ’ মায়ের খ্যাতাব পাওয়া নেত্রকোনার সীমা সরকারকে আলোচক হিসেবে নিয়ে আসেন। সীমা সরকার তার জীবনের গল্প সবার সাথে সহভাগিতা করেন। সীমা সরকার তার স্বাভাবিক চলাচলে অক্ষম (শারীরিক প্রতিবন্ধি) ছেলেকে কোলে করে স্কুল থেকে কলেজ এবং কলেজের গন্ডি পেরিয়ে কোলে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর গল্প অংশগ্রহণকারীদের সাথে সহভাগিতা করেন, যা বিশ্ববাসী অবগত। সীমা সরকার বলেন, ‘আমার ছেলেকে প্রতিদিন কোলে করে স্কুলে নিয়ে লেখাপড়া করানোতে সে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আমার পঙ্গু ছেলে যদি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়তে পারে তোমরা পারবে না কেন?’ সীমা সরকার এর উদ্বুদ্ধকরণমূলক আলোচনা শুনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মেয়েরা লেখাপড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং লেখাপড়া বন্ধ না করার শপথ নেয়।

লাবণী আক্তার গ্রামের অন্য সাধারণ মেয়েদের থেকে ভিন্ন। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি সম্পর্কে সে যেমন সচেতন, তেমনি গ্রামের অন্যদেরকেও এসব সামাজিক অসঙ্গতি থেকে মুক্ত করে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। গ্রামের কিশোর-কিশোরীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরণের কর্মপরিকল্পনা। লাবণীর মত গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীরা সমাজের অসঙ্গতি দূরীকরণে এগিয়ে আসলে সমাজের অসংগতিগুলো একদিন দূরীভূত হবে, সমাজ হবে আলোকিত। সমাজে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, নারী জাতি পাবে শিক্ষার সুফল, সবশেষে সমাজে শান্তি বিরাজ করবে।

happy wheels 2

Comments