হাটে হাটে ৭০ বছর

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

‘হাটে হাটেই কেটে গেল আমার জীবন।’ বলছি শ্রী আন্দন শীল (৮২) এর কথা। সকাল বেলায় লাহারী (সকালের নাস্তা) করে কাঁচি, চিরুনী, খুড় ও একটি টুল নিয়ে বের হয়ে পড়েন বারের হাটের উদ্দেশ্যে। আশেপাশে সপ্তাহের প্রতিটা দিনই কোন না কোন জায়গায় হাট থাকে। কখনও পায়ে হেটে কখনও ভ্যান-রিক্সায় করে সেই হাটে গিয়ে মানুষের খৌড়কার্য (চুল ও দাড়ি কাটানোর কাজ) করান তিনি।

তাঁর ১২ বছর বয়সে বাবা স্বর্গীয় জীতেন্দ্রনাথ শীলের কাছে হাতেখড়ি হয় খৌড়কার্য করার। কাকন হাটে আজ থেকে ৭০ বছর আগে সেই দিন মনে করে চোখের কোনে জল আসে আনন্দ শীলের। কারণ বাবা গত হয়েছে সেই কবে। তাঁর জীবনও শেষ পর্যায়ে। বাবা কাজ শিখিয়েছিলেন বলেই আজকেও সেই কাজ করে দুবেলা খাবার জোটাতে পারছেন বলে জানান আনন্দ শীল।


আনন্দ শীলের বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার কাকনহাটে। চার ছেলে মেয়ে সবাই বিয়ে করে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ এই বুড়ো বাবার খোঁজ নেয় না। আনন্দ শীলের স্ত্রী পদ্মবালা গত হয়েছেন ৮ বছর হলো। তিনি এখন নিজের সংসার একাই চালান।
প্রতি সোমবার তিনি সকাল সকাল চলে আসেন রাজশাহীর তানোরের মন্ডুমালা হাটে। সেখানেই আসছেন ৫০ বছর আগে থেকে। সারাদিন মন্ডমালা হাটে আগত মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে কারো চুল কারো দাড়ি কাটিয়ে দিয়ে ১৫-২০ টাকা করে নেন। এভাবে এখন দিনে ২০-২৫ জনের কাজ করে দিতে পারেন। আনন্দ শীল বলেন, ‘এখন আর বেশি কাজ করতে পারি না, আবার বুড়ো মানুষ বলে অনেকেই আর আমার কাছে কাজ করতে চাইও না। কিন্তু আজ থেকে কিছু বছর আগেও আমি মন্ডুমালা হাটে ৪০-৫০ জনের কাজ করে দিয়েছি।’


আনন্দ শীল আবেগপ্রবণ হয়ে আরো বলেন, ‘আমি প্রথমের দিকে কাকনহাট থেকে মন্ডুমালা হাটে পায়ে হেটে এসেও কাজ করেছি। তখন এত যানবাহন ছিল না।’ তখন কত করে আয় হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে আমি সারাদিনে ৩-৫ টাকা আয় করতাম তখন ভালোই চলত কিন্তু এখন ৩০০-৩৫০ টাকা আয় করেও তেমন ভালোভাবে সংসার চলে না।’


‘ঘাটে হাটেই তো কাটিয়ে দিলেন জীবন। কি পেলেন আর কি পেলেন না তার হিসেব কি কখনও মিলিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ হিসেব কোন দিনই মিলবে না। এ হিসেবে মেলানো খুবই কঠিন একটি কাজ। এখন চাই ভালোভাবে মরতে। তাহলেই তো জীবনের একটি সুন্দর সমাপ্তি হবে। আর এ সমাপ্তিই তো সবাই চায়।’
শেষ কথাগুলো শুনে মন খারাপ নিয়ে চলে আসলাম। সবসময় ভালো থাকুক আনন্দ শীল। ঈশ^র তাঁর মঙ্গল করুন।

happy wheels 2

Comments