বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস: সুরক্ষিত হোক ভোক্তার অধিকার

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান

ভোক্তা অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। কারণ ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার সম্পর্ক নিবিড়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুনাফাখোর, মজুতদারি, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নকল ভেজাল ও মানহীন পণ্যের দৌরাত্ম্যের কারণে আজ নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার এখানে ভূলুণ্ঠিত।

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন নিজের অবচেতন মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে ভেজালের ভীড়ে আমরা না ভেজালকে ঘিরে রেখেছি। কেননা একজন কৃষক যখন অধিক উৎপাদনের আশায় জমিতে রাসায়নিক সার বিষ দিয়ে ফসল উৎপাদন করছে তখন উৎপাদক হিসেবে সে কখনই চিন্তা করে না মাটি, পানি, বায়ু, প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। সংকুচিত করছে সকল প্রাণের টিকে থাকার পরিবেশ। সেই কৃষকই আবার তার উৎপাদিত ফসল বাজারে যখন বিক্রি করছেন তখন ভোক্তা হিসেবে আমি তা ক্রয় করছি ও ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আবার আমার বাড়ির গাভীর দুধে পানি মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছি তখন ঐ কৃষক ভোক্তা হিসেবে ক্রয় করছে সেও তখন ভোক্তা হিসেবে তার অধিকার হারাচ্ছে। পক্ষান্তরে আমরা দুজনেই ভেজালের মধ্যে আবদ্ধ। কিন্তু এখানে দুজনেরই ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ খাবার ও সমান অধিকার পাওয়ার কথা। তাছাড়া রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ করা, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের নাগরকিদের উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের নিশ্চয়তা বিধান করা।

এছাড়াও মৌলিক অধিকার হিসেবে নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে, বিনোদনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র’। অন্যদিকে রাষ্ট্র নাগরিকের জনস্বাস্থ্য উন্নয়নও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করবে। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন চলছে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য সমগ্র বাজারজাতকরণের অবিরাম প্রচেষ্টা। আমরা কেউ জেনে আবার কেউ বা না জেনেই এসব ভেজাল খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করছি। স্বাস্থ্যকর খাদ্য মানেই নিরাপদ খাদ্য। আর নিরাপদ খাদ্য মানে ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য। খাদ্যে ভেজালের অর্থ হলো খাদ্যে অতিরিক্ত উপাদান যুক্ত করা। এখানে কিছু খাঁটি উপাদানের সঙ্গে কিছু নকল ও ভেজাল উপাদান যুক্ত করা হয়। এ ভেজাল প্রক্রিয়ায় অনেক সময় প্রকৃত উপাদানের চেয়ে নিম্নমানের উপাদান যুক্ত করা হয়। সংগঠিত ভেজালের মধ্যে রয়েছে জুসে ফলের রস নেই, চাল-আটা, আলুতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রঙ, ঘি, মিষ্টিতে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রঙ, বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে পাকানো হচ্ছে ফল, মাছে, শুঁটকিতে দেয়া হচ্ছে ফরমালিন,পাউরুটি, নুডুলস, বিস্কুট ও মুড়িতে মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া, বিষাক্ত ক্যামিকেল ও রঙ। মাছে ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। ফলমূল পাকাতে ব্যবহৃত হয় কার্বাইড। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে সবজিতে সরাসরি কীটনাশক স্প্রে করা হয় এবং কীটনাশক সক্রিয় থাকতেই সেগুলো বাজারজাত করা হয়। গুঁড়া মসলা, চানাচুর ও রঙিন খাবারে ব্যবহার করা হয় শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কাপড়ের রং। আর এইসব পণ্য বাজারজাতকরণে ব্যবহার হচ্ছে চকচকে প্লাষ্টিক জাতীয় মোড়ক, প্লাষ্টিক বোতল ও পলিথিন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের রঙ ও প্লাষ্টিকে রয়েছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ ও ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহার করা ভোক্তা অধিকার পরিপন্থি। কাজেই ভোক্তা অধিকার সর্বজনীন ও সমানাধিকার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সর্বজনীন সমান অধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেই বিশ্বব্যাপি ভোক্তা অধিকার পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর সরকারি বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলো নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করে থাকে। এবারো সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস।

এবারের বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য : মুজিব বর্ষে শপথ করি’ প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি।’ প্লাস্টিক দূষণের কারণে পরিবেশ ও জলবায়ুর কি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং তা ভোক্তাদের জীবন ও জীবিকায় কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ভোক্তাদের জীবন ও জীবিকা এবং বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে এবারে প্রতিপাদ্যটি আমার কাছে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। কেননা প্রতিটি খাবার এবং জীবনযাত্রায় প্লাস্টিক পণ্য এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন প্লাস্টিক বর্জ্য কোনো স্থান দখল করে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে তখন প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি হয়। আমরা অনেকেই প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা জেনেও প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করছি। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য নানাভাবে মিশে যাচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে। যার ফলস্বরূপ উর্বর মাটি হচ্ছে অনুর্বর, জলাশয় জলজ প্রাণীর জন্য হয়ে উঠছে বিপজ্জনক। কাজেই সকল প্রাণের টিকে থাকার উপযোগি পরিবেশ তৈরি করে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন জরুরি। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। তাই, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ প্রতিরোধে বিশেষ নজরদারি রাখা প্রয়োজন । একইসঙ্গে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পলিথিন ও প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। জনগণকে অধিকতর সচেতন করার উদ্দেশ্যে এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৬২ সালের এই দিনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার এক বক্তব্যে ভোক্তার চারটি অধিকার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেন। এগুলো হলো-নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরও বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রতিবছর সরকারি বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলো নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করে থাকে।

সেই ধারাবাহিকতায় বারসিক ও সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বাংগালা নব কৃষক কৃষাণি সংগঠনের উদ্যোগের সাথে একাত্মতা পোষণ করে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে দিবসটি পালনে আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তারা ভোক্তার অধিকার সুরক্ষিত করার দাবিতে ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ এর বাস্তবায়ন ও কার্যকরী করার দাবি জানান। জেলা কৃষি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি করম আলী মাষ্টারের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক ছিলেন ব্রী কালিয়াকৈর বাজার কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসামান গনি আসমান, জেলা নারী উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিনা বেগম, বলধারা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আব্দুল লতিফ,সাংষ্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব জয়নাল আবেদিন, বারসিক কর্মকর্তা শিমুল বিশ্বাস,গাজী শাহাদাৎ হোসেন বাদল,ও সারমিন আক্তার।

happy wheels 2

Comments