একটু খানি পানির লাগি

শ্যামনগর,সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

‘আমাদের চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। যতদুর চোখ যায় শুধু পানি। কিন্তু সব পানি সুপেয় পানি নয়। এখানে লবণ পানি বেশি। এ লবণ পানির সাথে প্রতিনিয়ত বসবাস আমাদের। এ লবণ পানির সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে। লবণের মধ্য দিয়ে জীবনমান উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টার যেন শেষ নেই। যার যতটুকু জায়গা আছে সেখানে বিভিন্ন ধরনরে ফসল ফলানোর চেষ্টা চলেছে। এখানে মিষ্টি পানি বলতে তরকারি ধোয়া, চাউল ধোয়া পানি। আবার অনেকে সাধ্যমত নিজে থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ছোট বড় ড্রাম সহায়তা পেয়েছে। সেখানে যেমন বর্ষার মিষ্টি পানি সংরক্ষণ, তেমনি আবার দূর থেকে মিষ্টি পানি কিনে ড্রাম ভরে রাখতে হয়েছে। আবার কিছুক্ষেত্রে পুকুর খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে।’


উপরোক্ত কথাগুলো বলেন, শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের চুনা নদীর চরে বসবাসরত সুন্দরবন গুচ্ছ গ্রামের কৃষাণী করিমুন্নেছা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চুনানদীর চরে খাস জায়গায় বসবাস করি। আমার পরিবারে মোট লোকজন ৬ জন। ছেলে -ছেলের বৌ ও ছোট বাচ্চা নিয়ে প্রতিবছর ৬ মাসের জন্য ভাটায় কাজ করতে যায়। আমি আমার বৃদ্ধ স্বামী ও নানতিকে নিয়ে বাড়ি থাকি। মাঝে মধ্যে আমি যোন মজুরিও দিইি। স্বামীর বয়স হয়ে গেলেও তিনি বসে থাকেন না। সারাদিন বাড়িতে কি ফসল লাগানো যায় তার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। বছরে প্রায় সময় কোন না কোন সবজি ফসল আমাদের ক্ষেতে থাকে। এবছর ছেলে ও ছেলে বৌ ভাটায় যাওয়ার আগে আমাদের পুকুরটি খনন করা হয়। এ বছর বেশি করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করতে পারবো, যা দিয়ে সবজি বেশি চাষ করতে পারবো। কিন্তু আমাদের সে আশায় গুড়ে বালি। কারণ জানুয়ারি ও ফ্রেব্রয়ারি মাসের দিকে যারা ঘের করে তারা খালে লবণ পানি উঠিয়ে তাদের ঘেরে লবণ পানি তোলেন। খালে লবণ পানি এতোটা উঠায় যে আমাদের পুকুরে লবণ পানি চুয়ে চুয়ে প্রবেশ করে এবং সব পানি লবণ হয়ে যায়।’

করিমুন্নেছা বেগম আরও বলেন, ‘ক্ষেতে শীত মৌসুমরে প্রায় সব রকমের সবজি ছিলো। সাথে আরো নতুন করে ঢেড়স, বরবটি, শিম, লাউ লাগিয়েছি। কিন্তু পানি লবণ হয়ে যাওয়াতে সবগুলো এখন নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেত এখন ধুধু মরুভূমি। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের সবজির বীজ সংরক্ষণ করা ছিলো এবং কিছু বাজার থেকে ক্রয় করা ছিলো তা সব পড়ে আছে। এখন শুধু আকাশের পানিই ভরসা। কবে যে বৃষ্টি হবে সেই আশায় আছি। সুপেয় পানি থাকলে সব কিছ’ু করা সম্ভব। শুধু একটু খানি পানির লাগি বসে আছি। মিষ্টি পানি হলে চুনা নদীর চরে আবার সবুজ আর সবুজ পরিবেশ করতে পারবো।’

তিনি জানান, চুনার নদীর চর হলেও তাদের বাড়িতে বারোমাস কোন না কোন সবজি থাকতো। সবজি গ্রামের মানুষ যেমন এখান থেকে কিনে নিয়ে যেতো, তেমনি বাজারে গিয়েও বিক্রি করতেন। মোট জায়গা জমি বলতে তাঁদের এই ১০ কাঠা জায়গা। এখানেই তারা নানান ধরনের সবজি চাষাবাদ করেন। অতিরিক্ত লবণ পানি প্রবেশের কারণে এবছর তাদের বড় একটা ক্ষতির সম্মুখিন হতে হলো। ক্ষেতের সবজি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি ছাগল, মুরগি যা ছিলো তা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। কয়েকটি মারাও গেছে। এখনও ছেলে ও ছেলের বৌ ভাটা থেকে ফেরেনি। বসতভিটায় যা হতো তাতে তাদের ভালোই চলে যাচ্ছিলো। ভাটা থেকে কিছু না পাঠালেও চলতো। কিন্তু এখন আর চলছে না! বাধ্য হয়ে তাদেরকে যোন মজুরির কাজ করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র মিষ্টি পানির অভাবে তাদের এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। ক্ষেতের মধ্যে একটা পেঁপে গাছ জীবিত আছে। সব কিছু আবারও সম্ভব শুধু একটু মিষ্টি পানি হলে।

অন্যদিকে লবণ পানির কারণে করিমুন্নেছা বেগমদের শুধু সবজি ও গবাদী পশুর ক্ষতি হয়নি। পুকুরের নানান ধরনের স্থানীয় মাছও মারা গেছে। এমনিতে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ততা এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত। এ দুর্যোগ ও লবণাক্ততার সাথে বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা উপকূলবাসীর। কিন্তু দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করলেও লবণাক্ততার কাছে হারতে হয়েছে অনেক সময়। কারণ ইচ্ছা না থাকা এবং অনাকাঙ্খীতভাবে লবণ পানি প্রবেশ করায় জীবনমান হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

happy wheels 2

Comments