একজন সফল তরুণ উদ্যোক্তা জাভেদ আহমেদ

রাজশাহী থেকে শামীউল আলীম শাওন ও রিনা আক্তার

‘২০১৫ সালের ঈদ-উল-আযাহার সময়। সবাই ব্যস্ত গরু-ছাগল নিয়ে। আর আমার ইচ্ছা জন্মে ব্যবসা করার। তখন উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি অল্প বয়স থেকেই টিউশনি করতাম। টিউশনির বেতনের মাত্র এক হাজার টাকা ছিল হাতে। সেই টাকা দিয়েই আউর (খড়) কিনে ফেলি। তা নিয়েই শুরু করি জীবনের প্রথম ব্যবসা।’ এমনভাবেই জীবনের প্রথম ব্যবসার অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জাভেদ। অনলাইন ই-কর্মাস প্লাটফর্মে ব্যবসা করে ইতিমধ্যেই তিনি অর্জন করেছেন ব্যাপক সফলতা, হয়েছেন লাখপতি। অনলাইন ই-কর্মাস প্লাটফর্মে যদিও পরিচিতি লাভ করেছেন জাভেদ আহমেদ নামে।
তরুণ এই উদ্যোক্তা রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অর্নাস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ফরিদপুরের ভাংগা উপজেলার নাজিপুর গ্রামের মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও জয়নব বেগম দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান। স্বপরিবারে থাকেন ঢাকার বাসাবো-তে।
তরুণ উদ্যোক্তা জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘জীবনের প্রথম এক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মৌসুমি ব্যবসা করি। যাতে উপাজর্ন করি প্রায় চারশত পঁয়ষট্টি টাকা। বিনিয়োগসহ প্রথম উপর্জনের সম্পূর্ণ টাকাটা তুলে দিয়েছিলাম মায়ের হাতে। মা টাকাটা হাতে নিয়ে গুনেন আর দোয়া করেন। এরপর ফিরিয়ে দেন আমার হাতে। মায়ের সেই দোয়াটাই আমার কাজে দিয়েছে।’

নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় থেকেই নিয়মিত টিউশনি করেন। নিজের দৈনিন্দন খরচ মিটিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন। নিজের হাত খরচ তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে নিজের পড়াশোনা খরচেও যোগান দেন। পরনির্ভরশীতা বা কারো অধীনে কাজ করা পছন্দ করেন না। তাই চাকরির বদলে ব্যবসাকে প্রধান্য দেন বেশি। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টার চালুও করেন তরুণ উদ্যোক্তা জাভেদ আহমেদ।

২০২০ সালের ১৬ মার্চ করোনা মহামারীর ফলে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশব্যাপী ঘোষণা করা হয় লকডাউন। ফলে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের হল ছেড়ে ঢাকায় বাড়িতে চলে যান। লকডাউনের ফলে দীর্ঘদিন বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকায় একসময় বিরক্তি লাগা শুরু হয়। হঠাৎ-ই জুন মাসের দিকে ‘আম’ নিয়ে ব্যবসার নতুন আইডিয়া মাথায় আসে। ঢাকাতে রাজশাহীর আমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যবসা করার জন্য রাজশাহীতে চলে আসেন। রাজশাহী থেকে কিনে আম ঢাকায় পাঠান। ঢাকার বাসাবোতে আপন বড় ভাই মনিরুল ইসলাম আমের অস্থায়ী দোকান করেন। এভাবে ভাইয়ের সহযোগিতায় মৌসুমী ফলের ব্যবসা করেন। সফলও হন। কিন্তু সেই ব্যবসা শেষ হওয়ার আগেই মাথায় চলে আসে অন্য ব্যবসার নতুন আইডিয়া। কোনভাবে অনলাইন প্লাটর্ফমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাবেচা করা যায় কিনা ভাবেন তিনি। সেই আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ‘স্মার্ট টেক’ নামের একটি ফেসবুক পেজ খুলেন। পনের হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন ব্যবসায়। হেডফোনসহ নানা ধরণের গ্যাজেট নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়িক প্রচারণা শুরু করেন আত্মীয়স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবীদের মাঝে। পণ্যের তালিকায় তখন ছিল ঘড়ি, মোবাইল গ্যাজেট, নারীদের জুয়েলারী। অনলাইনে শুরুর পূর্বেই অফলাইনে পণ্য বিক্রি হয় তার। যার প্রথম ক্রেতা ছিল তার আপন বোন। যার নাম রাহিমা আক্তার সোনিয়া। ১২ সেপ্টেম্বর একশ টাকায় একটি রিং ও দুইশ টাকায় ব্রুজ বিক্রি করে তার কাছে। আর বড় ভাইয়ের কাছে পাঁচশ টাকায় বিক্রি করে ঘড়ি। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনে শুরু করে সেই মাসের ২৮ তারিখে অনলাইন পেজে (স্মার্ট টেক) প্রথম অর্ডারটি পান জাভেদ। পাঁচশ টাকা মূূল্যের একটি ও একশ টাকা মূল্যের একটি মোট দুটি হেডফোনের প্রথম অর্ডার হয়। এরপর একের পর এক অর্ডার পেতে শুরু করেন।

এদিকে তিনি খোঁজ পান যে পেজের পাশাপাশি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেও বেশ ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। ফলে তিনিও সেই সুযোগকে কাজে লাগান। অক্টোরব মাসের দিকে যুক্ত হন বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে। তার মধ্যে ‘স্টুডেন্টস্ ই-কর্মাস প্লাটর্ফম’ নামক ফেসবুক গ্রুপে প্রথম পোষ্টেই তিনি ব্যাপক সাড়া পান। আর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিতীয় পোষ্ট দিয়ে প্রায় ১৫টির মত অর্ডার পান। যার বিক্রয় মূল্য ছিল প্রায় আট হাজারেরও বেশি।

এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাঁকাতে হয়নি। একের পর এক অর্ডার হাতে আসতে থাকে তার। দেখতে দেখতে তার ক্রেতার সংখ্যা আর বিক্রি বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে রিপিট কাস্টমারও গড়ে ওঠে। প্রায় অর্ধশতাধিক নিয়মিত ক্রেতা রয়েছে তার। আর আড়াই থেকে তিনশতাধিক ক্রেতার কাছে তার পণ্য পৌঁছে গেছে। যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সক্রিয় আছেন সেই গ্রুপেও। শুধুমাত্র অনলাইন ব্যবসায় সাত মাসে প্রায় দুই লক্ষাধিক টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। আর চলতি মাসে মাত্র তেইশ দিনে (২৩ মার্চ পর্যন্ত) ৪৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন।

তরুণ উদ্যোক্তা জাভেদ আহমেদ বলেন, ‘অল্প লাভে বেশি পণ্য বিক্রি করার মন-মানসিকতা নিয়ে কাজ করার জন্য অল্প মূল্যে ভালো পণ্য দেয়ায় আমার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করি। আর আমার বিক্রি বৃদ্ধি পেতে থাকে।’
অদূর ভবিষ্যতে বেকারত্ব দূরীকরণে তিনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন এবং নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও তাদেরকে সহায়তা করতে চান। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার ভবিষ্যতে পরিকল্পনা আছে অনলাইন ব্যবসাটাকে আরো বড় করে তোলার ও পাশাপাশি একটি আইটি ফার্ম করার। যাতে নতুনদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করার লক্ষ্যে পাইকারী পণ্য বিক্রি করতে চাই। যাতে নতুনদের ব্যবসা করার জন্য পণ্য পেতে কষ্ট না হয়।’

happy wheels 2

Comments