বিলুপ্তির পথে লোকখাদ্য মাঠা

মানিকগঞ্জ থেকে মো.নজরুল ইসলাম
বৈশি^ক পূঁজিবাদের ফসল প্রতিযোগিতামুলক বাজার অর্থনীতির বিকাশ হলেও পূঁজিপতিদের একচেটিয়া দাপটে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়িরা বাজারে টিকতে পারে না। কোম্পানি ও দোকনদারি ব্যবসার প্রসারে অন্যদিকে দেশের হাটবাজারগুলো ভাঙতে ভাঙতে গ্রামগঞ্জের গন্ডি ছাড়িয়ে মানুষকে হাটবাজার বিমুখ করেছে এবং বাজারই এখন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে অলিতে গলিতে প্রবেশ করেছে। বৈশি^ক পূঁজিবাদের কারণে মুনাফালোভী কোম্পানিরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের উৎপাদিত লোকায়ত হরেক রকমের পণ্য যখন কোম্পানি নামে লেভেল পেটেন্ট ও মোড়কজাত করে বাজারজাত করে তখন মহাদেব ঘোষের মতন মানুষগুলো অসহায় থেকেই যায়।


আমি একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে মানিকগঞ্জ শহরে থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে চলাফেরা করলেও বেতিলা,পালড়া ও সিংগাইর রোডে যাতায়াত একটু বেশি হয়। পালড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে আমিসহ অনেকই মহাদেব ঘোষের মাঠা পান করে ধন্য হয়েছি। কিছুদিন হয় দেখছি না মহাদেব ঘোষকে। এদিকে চলছে বৈশি^ক মহামারী করোনাকাল। অনেকদিন হয় ভাবছি একটু দেখা করবো তার সাথে। তাঁর জীবন ও জীবিকার খোঁজখবার নিতে তাই সহকর্মী গাজী শাহাদত হোসেন বাদলের সহাযোগিতায় বেতিলা বাজারে দেখা হলো মহাদেব ঘোষের সাথে। করোনাকালে বেচাবিক্রি ভালো না। মাঠা আগের মতো চলে না বলে বিলাপ করলেও এক ধরনের আনন্দও খুঁজে পেলাম তার মাঝে।


ঐা হোক জনপ্রিয় লোকখাদ্য ঘোল বা মাঠা প্রায় বিলুপ্তির পথে হলেও মাঠার গুণগতমান ভালো হলে এখনো তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। গ্রীষ্মকালের প্রচন্ড তাপদাহে ক্লান্তি দূর করতে এক গ্লাস মাঠা সবার কাঙ্কিত খাদ্যপান ছিলো। আগের দিনে হাট বাজারে ও গ্রামের অলিতে গলিতে প্রায় সারাবছরই গোয়ালারা ফেরি করে মাঠা দই বিক্রি করতো। ফেরিওয়ালা ঘোষেরা গ্রামের পথে প্রান্তরে ডাক ছাড়তেন এই বলে ‘এই লাগবে মাঠা, দিদি মাঠা লাগবেনি’? ইত্যাদি। এখন আর এই রকম হাক ডাক চোখে পড়ে না। সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষরে জন্য স্বস্তিদায়ক পুষ্টিকর খাবার হলো মাঠা। গ্রামের গৃহিনীরা চৈত্রমাসে বাড়ির রাখাল কৃষকদের জন্য মাঠা সংগ্রহ করে রাখতেন।

এই প্রসঙ্গে মহাদেব ঘোষ বলেন, ‘গোয়ালারা দুধ থেকে ননী তুলে মাঠা তৈরি করেন। প্রথমে দুধ গরম করে ঠান্ডা করে তাতে টক দই মেশানো হয়। এক খন্ড বাঁশ ফেড়ে ’চরকা তৈরি করে তার আগ মাথায় রশি লাগিয়ে দুইদিক থেকে সাধারণত নারী-পুরুষ দুইজন রশি টেনে দুধ মন্থন করে ননী আলাদা করার পর দুধের যে জলীয় অংশ থাকে সেটিই হচ্ছে মাঠা।’ আমার গিন্নী বলতেন ‘দুধ থেকে ছানা বের করার পর যে জলীয় অংশ থাকে সেটি দিয়েও মাঠা তৈরি করা যায় তবে সেটি অধিক পাতলা হবে।’ উল্লেখ্য যে, ননী থেকে ঘি তৈরি করা হয়। ননীমুক্ত দুধের জলীয় অংশের সাথে লবণ চিনি বা স্যাকরিন মিশিয়ে খাবারের উপযোগী মাঠা তৈরি করা হয়। আজকের দিনে এই ধরনের মাঠা খুবই কম চোখে পড়ে।


আমাদের মানিকগঞ্জের একটি লোকায়ত ঐতিহ্য রয়েছে। এখনো জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা খেলা হাটে বাজের মাঠা দেখা যায়। বর্তমান সময়ে বৈশি^ক মহামারী করোনাকালের কারণে এই পেশার মানুষগুলো খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন সেটি মহাদেব ঘোষের জবানিতেই ফুটে উঠেছে। মহাদেব ঘোষ আরো বলেন, ‘আমি বাবার সাথে পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন হাটে যাইতাম তখন দশ পয়সা,এক টাকা,দুই টাকা গ্লাস করে প্রচুর মাঠা বিক্রি করতাম এবং লাভও হইতো প্রচুর। এখন দশ টাকা, বিশ টাকা গ্লাস মাঠা বিক্রি করেও সংসার চালাইতে হিমশিম খাইতে হয়। দুধ,গুড়,চিনি,সেকারিনের দামের পাশাপাশি আগুনও এখন কিনতে হয় লাকরির দাম বাড়তি হওয়ায়। কোন কিছুতেই সুখ নেই। তারপরও বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারছি না। এই প্রজন্ম আর এগুলো করতে চায় না। আর সব ধরনের রসনা খাবার মোড়কজাত হওয়াতে গুণগত মান ভালো না হলেও বাজারে সবই পাওয়া যায়। আরো কথা হলো এই প্রজন্ম মাঠার চেয়ে বোতলজাত পানিও বেশি পছন্দ করে। লোকায়ত ফটকা কারবার না করে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে চাকরি বাকরি করুক তাতে লাভ বেশি হবে বলে আমি মনে করি।’


মানিকগঞ্জ দাশরা গ্রামের সুভাষ ঘোষ বলেন, ‘মাঠা পেটের জন্য খুবই ভালো ও উপকারি। এটি পিত্ত ঠান্ডা রাখে। সমস্যা হলো টিভিতে এর বিজ্ঞাপন নেই। তাই এই প্রজন্ম চিনে না তারা চিনে আরসি,কোকলা,ফান্টা,স্পীড ইত্যাদি।’
লোক খাদ্য মাঠার চাহিদা কমলেও মুরুব্বীদের মাঝে বাংলার হাটে মাঠে এর আবেদন কোনদিন কমবে না। সরকার পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তরিক হলে এই পেশাদারদের প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিলে এখনো এই পেশা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। আমরা গোয়ালাদের সমাজে সম্মান চাই। তাদের ন্যায্য অধিকার চই। আমরা আরো বিশ^াস করি বহুত্ববাদী সাংস্কুৃতিক সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আরো বৃদ্ধি করতে হবে।

happy wheels 2

Comments