করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গ্রামকেও প্রাধান্য দিন

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ঘোষণা দেয় ৮ মার্চ,২০২০ তারিখে। সেদিন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের থেকে প্রথমবারের মত জানানো হয় বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এই ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত এক বছর পার হয়েছে কয়েকমাস আগেই। একসময় গ্রামের মানুষ মনে করতো করোনা বুৃঝি ধনীদের রোগ, শহুরে মানুষের রোগ। বিগত একবছরে গ্রামগুলো ছিলো নিরাপদ, তেমনভাবে করোনার সংক্রমণ ছড়ায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস সব থেকে বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে। উপরোন্তু যোগ হয়েছে ভারতীয় ডেলটা ভেরিয়েন্ট। শহরের হাসপাতালগুলোতে এখন গ্রামের করোনা রোগী দিয়ে ভরপুর। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সূত্রমতে এখন সেখানে গ্রামের করোনা রোগীর সংখ্যাই বেশি।

করোনা কেন্দ্রিক জনসচেতনতার জন্য দীর্ঘ একটি বছরের বেশি সময় পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু করোনাভাইরাস কেন্দ্রিক জনসচেতনতা এবং করোনা ভাইরাস কেন্দ্রিক সকল সেবাগুলোর বেশিরভাগ ছিলো শহর কেন্দ্রিক। করোনা ভাইরাসের টিকা, পরীক্ষা এবং সকল সেবাগুলো আমাদের দেশের গ্রাম বা ইউনিয়ন কেন্দ্রিক কেন্দ্রগুলোতে এখন পর্যন্ত আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। যা পরিকল্পনার ঘাটতি হিসেবেই মনে করা যায়। অথচ বাংলাদেশের বৃহৎ এক জনগোষ্টী প্রায় শতকরা ৮০% মানুষ বসবাস করে গ্রামে। গ্রামকে কেন্দ্র করেই শহরের খাদ্য চাহিদাসহ নানা চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। করোনা ভাইরাসের সেবা পরিসেবাগুলোতে আমরা কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছি কম। অথচ সবসময় সবখানে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমাদের অর্থনীতি আরো অগ্রসরমান হচ্ছে। করোনাকালিন খাদ্য সংকট মোকাবেলায় এই কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষরাই আমাদেরকে বাঁিচয়ে রেখেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য সরকারের প্রদেয় সেবাগুলো আমরা তাঁদের জন্য, তাঁদের মতোকরে গড়ে তুলতে পারিনি। গ্রামের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকজজ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা করোনাভাইরাসের জন্য জনসচেতনার দিকগুলো ছড়িয়ে দিতে পারতাম। গ্রামের মানুষ বিদেশি ভাষা লকডাউন, কোয়েরেন্টাইন এসব ভাষা কম বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু এই বিষগুেেল্ইা যদি তাদের আপন সংস্কৃতি এবং নিজের ভাষায় বোঝানো যেতো তাহলে আমরা বর্তমান এই মহাসংকটগুলো থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতাম। এইসব বিষয় নিয়ে অঞ্চল কেন্দ্রিক জনসচেতনতা প্রচারের কৌশল নির্ধারণে ছোট ও স্বল্প পরিসরে গবেষণা করেও আমরা নির্ধারণ করতে পারতাম। সেই সুযোগগুলো আমরা এখনো কাজে লাগাতে পারি। আমরা গ্রামের মানুষের, স্থানীয় জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা সংস্কৃতি ব্যভহার করে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জনসচেতনার দিকগুলো গুরুত্ব দিতে পারি। এবং তাঁদের কৌশলগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি।


সময় হয়েছে সেগুলো গুরুত্ব দেবার। কিন্তু আমরা এখনো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছিনা এবং ভাবছিনা। এ বিষয়ে কোন উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো নয়। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়গুলো আলোচনা ও পর্যালোচনা হওয়া খুবই জরুরি এখন। ইদানিং শহরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে করোনা সংক্রমণ কম দেখা দিচ্ছে। আবার শহরের মানুষরাই এই করোনা প্রতিরোধে সরকারের সকল সেবাগুলো বেশি পেয়েছে। যেমন করোনা টেস্ট, করোনা ভ্যাকসিনসহ নানা সেবাগুলো তারাই বেশি পেয়েছে। যার ফলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতা ও সেবার দিক থেকে গ্রাম পিছিয়ে পড়েছে। যার খেসারত এখন বাংলাদেমের গ্রামবাসীগণ দিচ্ছে। রাজশাহী অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামগুলোতে সর্দি-কাশি ও জ¦রে আক্রান্ত রোগী মারাত্মকহারে বেড়েছে। সঙ্গে অনেকের গলায় ব্যাথা রয়েছে। কিন্তু অতীতের মতো এসব রোগ এমনিতে ভালো হয়ে যাবে-এমন ধারণার পাশাপাশি সেই রোগীকে সেবার জন্য পরিবারের সবাই গিয়ে সেবা শশ্রুষা বা আদর যতœ করছেন। এভাবে গোটা পরিবারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপশি গ্রামে সামজিক দুরুত্বের বিষয়টিও কোনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেনা বিধায় এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলাফল ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। খুব সম্প্রতি আমরা ভারতে চিত্র থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আবার দেখা যাচ্ছে এমনসব উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে চান না। এবং অনেকে এই সেবা অনেক দুরবর্তী শহরে হওয়ায় যেতে চাননা। গ্রামের মানুষের মধ্যে এই করোনা মহামারী প্রতিরোধে-জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দ্রুত ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড ভিত্তিক বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে কমিটি গঠন করে মানুষের সর্দি-কাশি জ¦রসহ করোনা উপসর্গগুলো দেখা দিলে তার পরীক্ষা করানোর জন্য সহযোগিতা করা। এবং এই কমিটি গ্রামের মানুষর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে মসজিদে, মন্দিরেসহ বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করতে পারবে। মাস্ক পড়া ছাড়া যেন কেহ ঘরের বাহিরে বা জনসমাগমে আসতে না পারে, সবাই মিলে এই সময়ে আড্ডা দিতে না পারে সে দিকগুলো দেখভাল করতে পারবে। পাশাপাশি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে করোনা ভাইরাসের টিকাসহ করোনা চিকিৎসা সেবাগুলো আরো উন্নত করা যেতে পারে। উপজেলার স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ, হাই ফ্লো নেজাল ক্যানোলা সরবরাহসহ করোনা চিকিৎসা সেবা সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

গ্রামের মানুষের জন্য এই সময়ে খুব জরুরী হয়েছে পড়েছে করোনা টেস্ট। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে দ্রুততার ভিত্তিতে র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট সেন্টার চালু করা দরকার। তা না হলে গ্রাম পর্যায়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

happy wheels 2

Comments