‘ঢোপকল’ আমার পরিবারের ৭০ বছরের তৃষ্ণা মিটিয়েছে

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
সন্তোষ কুমার রযোয়ার (৭০) বসবাস করেন রাজশাহীর শহরের উপকন্ঠে কুমারপাড়া এলাকায়। বাসার পাশেই রয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী একটি ঢোপকল। প্রচন্ড গরমের কারণে তিনি ঢোপকল থেকে পানি নিয়ে মুখচোখ ধুয়ে খানিকটা খেয়েও নিলেন। দেখেই মনে হলো তিনি পরম তৃপ্তি পেলেন। তখন কথা শুরু হয় তাঁর সাথে।


সন্তোষ কুমারের জন্ম ১৯৫০ সালে রাজশাহীর কুমার পাড়া এলাকতেই। বাবা মহাদেব কুমার রয়োয়ার ধোপার কাজ করতেন। অনেকদিন হয় বাবা মা গত হয়েছেন। এখানেই তিনি বড় হয়েছেন তাঁর সব কিছু এখানেই। যখন বুদ্ধি হয় তখন তিনি দেখতেন এই ঢোপকল থেকে তাঁর মা আনন্দময়ী পানি নিয়ে এসে তাঁদের খাওয়াতেন। দুপুর হলে সেখানে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ৬ ভাইকে গোসল করাতেন। ছয় ভাইয়ের মধ্য সন্তোষ কুমার ৩য়। পরিবারে অভাবের কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি।


বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সমস্যা প্রকট হলেও রাজশাহীর শহরের প্রান্তিক মানুষের সুপেয় পানির কোন সমস্যা হয়নি এই ঢোপকল থাকার কারণে। প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা তাঁরা এখান থেকে পূরণ করতে পেরেছেন। যেমন সন্তোষ কুমার বলছেন, ‘আমার এই বয়স পর্যন্ত আমি কখনও দেখিনি এই কলের পানি চলে গিয়েছে। আমি ছোট বেলায় দেখেছি গরমের সময় এই কলের পানি ঠান্ডা এবং শীতের সময় এই কলের পানি গরম বের হতো। গরম বলতে চাপকল থেকে শীতের সময় যেরকম পানি বের হতো সে রকম। আবার কোন দিন দেখেনি এই কল থেকে নোংড়া পানি বের হয়েছে। এখন অযতœ ও অবহেলার কারণে এবং যখন পরিষ্কার করা হয় মাঝে মাঝে ২-৩ দিন নোংড়া পানি বের হয়।’

অতীতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ যথা কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় লেগেই থাকত। এতে অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। শহরের বাসিন্দাদের সুপেয় পানির ব্যাবস্থাপনার জন্য ১৯৩৪ সালের তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান রায় ডি. এন দাশগুপ্ত রাজশাহীবাসীর এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই রাজশাহী পৌরসভা সিদ্ধান্ত নেয় শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে পানি সরবরাহের কল স্থাপন করার। পৌরসভার এই উদ্যোগে এগিয়ে আসে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। তাঁরা শহরের ধনী ব্যক্তিদের থেকে আহব্বান জানান এই কাজে সহযোগিতার জন্য। এই কাজে পুঠিয়ার মহারনী হেমন্তকুমারী একাই দান করেন ৬৫ হাজার টাকা। তাঁর এই অবদানের জন্যই এ কাজের নাম দেওয়া হয় ‘মহারানী হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস’। ১৯৩৪-১৯৩৭ সালের মধ্যে। রাজশাহীর প্রায় গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং প্রয়োজনীয়তা মিলিয়ে শতাধিক ঢোপকল নির্মাণ করা হলো। ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করল ‘মহারানী হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস’। সমাধান হলো রাজশাহী শহরের সুপেয় পানির সমস্যা।
একে এক চলে গেল প্রায় ৮৪টি বছর এই ঢোপকলেই মিটল রাজশাহীর তৃষ্ণা। শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি শহরের আয়তন বৃদ্ধি ও শহরের রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য অনেক ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলা হলো। সমস্যার কারণে কিছু ঢোপকলে পানি সরবরাহ বন্ধ করা হলো। কোন কোন মোড়ে ঐতিহ্যও স্মারক হিসেবে রয়ে গেল কয়েটি ঢোপকল। কোনটি পেল যাদুঘরে স্থান কোনটি পেল ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় স্থান, আবার কোনটি হয়েগেলো একেবারেই বিলীন। রাজশাহী ওয়াসার তথ্যমতে, বর্তমানে ১০-১১টি ঢোপকলে পানি সরবরাহ করা হয়।


তাঁর মধ্যই সন্তোষ কুমারের পাড়া একটি ঢোপকল। এটিও নাকি ভাঙ্গার জন্য বিভিন্ন সময় কথা হয়। তখন তাঁরসহ ১০-১৫টি পরিবার বর্তমান রাজশাহী সিটি করপোরেশনে দৌড়া দৌড়ি করে ভাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করে এই কলটিকে। কারণ তাঁর ছেলেরও যে এই ঢোপকলেই মিটছে ৫০ বছরের তৃষ্ণা। এভাবেই রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই ঢোপকল তৃষ্ণা মেটাক অনাগত আরো অনেক প্রজন্মের। এই চাওয়া সন্তোষ কুমারের মত আরো অনেক শহরের প্রান্তিক মানুষের।

happy wheels 2

Comments