বাইর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের ভেলুয়াতলী গ্রাম। এ গ্রামে আছে প্রায় ৪০০টি পরিবার। এ গ্রামে সবাই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এছাড়া গ্রামে রয়েছেন কৃষি শ্রমিক, বর্গা চাষি, ব্যবসায়ী, অটো চালক, চাকুরীজীবী। জীবিকার জন্য অনেকে ঢাকাতেও অবস্থান করছেন। এ গ্রামের নারীরা বলতে গেলে সবাই উঠানে শাকসব্জি চাষ, হাঁস মুরগি, গরু, ছাগল পালন করে সংসারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করে আসছেন।


এ গ্রামেরই ১১টি পরিবার সারাবছর বাইর (মাছ ধরার উপকরণ) তৈরি করেন। আজ থেকে অনেক বছর আগে থেকেই তারা এই বাইর তৈরির কাজে নিয়োজিত। এটি তাদের ঐতিবাহী পেশাও বটে। নারী ও পুরুষ উভয়ই সংসারের কাজ সেরে বসে পড়েন বাইর তৈরির কাজে। সারাদিনই চলে বাইর তৈরির এই কাজ। এমনও দেখা গেছে, একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করছে কিন্তু হাত থেমে নেই! মুুখে গল্প গুজব করছে আর হাত দিয়ে বাইর বুনছেন অনেকে। বাইর তৈরির জন্য একটি গোলাকার চাক তৈরি করতে হয়, যা নারীরা তৈরি করতে পারেন না। এজন্য পুরুষের সহায়তা নিতে হয়। কৃষি কাজের অবসর সময়ে পুরুষরাও বাইর তৈরির কাজটি করেন। বাজার থেকে বাঁশ কিনে নিয়ে আসা ও বাইর বাজারে নিয়ে বিক্রির কাজটি পুরুষরা করেন। বর্ষা মৌসুমে যদিওবা বাইরের চাহিদা বেশি থাকে কিন্তু তাদের এই বাইর তৈরির কাজ চলে সারা বছর। ১২ মাসের মধ্যে ৪ মাস বাইর বিক্রি করা হয় না। ৪ মাস বাইর বিক্রি না হলেও তারা বাইর তৈরি করে ঘরে সংরক্ষণ করেন। যখন বৃষ্টি হওয়া শুরু হয় তখন সংরক্ষণকৃত বাইরগুলো একটু বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। বর্ষার শুরুতে বাইরের চাহিদা বেশি থাকে এবং দামও ভালো পাওয়া যায় বলে জানান আব্দুল হেলিম।


বাইর তৈরির প্রক্রিয়া
বাইর তৈরি করতে দুটি প্রধান উপকরণ প্রয়োজন হয়। বাঁশ ও প্লাস্টিকে সুতলী। ১১ পরিবারের মধ্যে সবাই বাজার থেকে বাঁশ কিনে বাইর তৈরি করেন। প্রতিটি বাঁশের দাম পড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। মোটমুটি বড় একটি বাঁশ দিয়ে প্রায় ২২ থেকে ২৫টি বাইর তৈরি করা যায়। ৪ জন মানুষ যদি সমন্বয় করে কাজ করেন তাহলে ৫ দিনে ২৫টি বাইর তৈরি করা সম্ভব বলে জানান আব্দুল মোতালিব। প্রতিটি বাইরের আকার আকৃতি অনুযায়ী দাম পড়ে ৪০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।
বাইর তৈরির জন্য বাজার থেকে বাঁশ কিনে এনে সাইজ মত কেটে নেওয়া হয়। তারপর সেটি পুকুরের পানিতে প্রায় ৭ দিন ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সে বাঁশ দিয়ে ছোট ছোট কাঠি তৈরি করা হয়। কাঠি তৈরি করা শেষ হলে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর কাঠিগুলো আগুনে সেক দেওয়া হয় যাতে কোন ধরণের কোন আঁশ না থাকে। তারপর তৈরি করা হয় মাছ ধরার উপকরণ বাইর।

বাইরের প্রকার ভেদ
মাছ ধরার জন্য যে বাইর তৈরি করা হয় সেটি আবার বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন পেসা বাইর, কাট্টুয়া বাইর, দরিবাইর, উইন্না বাইর, টাঙ্গাইলা বাইর, ধুলুক বাইর, সামুক বাইর প্রভৃতি। এসব বাইরের নাম যেমন ভিন্ন তেমনি এগুলোর ব্যবহারও ভিন্ন যেমন: কোনটা কম পানির জন্য, কোনটা বেশি পানির জন্য, কোনটা ছোট মাছের জন্য, কোনটা বড় মাছের জন্য, কোনটা ছোট আইয়ের জন্য, কোনটা বড় আইলের জন্য, কোনটা আবার আইলবিহীন স্থানের জন্য, কোনটা পানি কম ¯্রােতের জন্য, কোনটা পানির বেশি ¯্রােতের জন্য। এভাবে স্থান বিশেষে বাইরের আকার আকৃতিও ভিন্ন ভিন্নভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে। সব ধরণের বাইর আবার সবাই তৈরি করতে পারেন না। আবার আকার আকৃতির ভিন্নটার উপর নির্ভর করে বাইরের দর দামও।


কোভিড-১৯ এর মহামারীর জন্য সরকার ঘোষিত লকডাউনে বাইর তৈরির কাজ চলমান থাকলেও বিক্রি কমে গেছে। ঠিকমত বাজারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে যাদের প্রয়োজন তারা বাড়িতে এসে বাইর কিনে নিয়ে যান। এভাবেই চলছে কোভিড-১৯ মহামারীতেও তাদের কাজ কর্ম।

happy wheels 2

Comments