সচেতনতাই পারবে আমাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে

সচেতনতাই পারবে আমাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বারসিক’র উদ্যোগে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে করোনাকালীন সময়ে কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যা বিষয়ক এক অনলাইন আলোচনা সভা। উক্ত সভায় নেত্রকোণা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী সংগঠনের সদস্য, বারসিক’র নারী কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন। কিশোরীদের বয়োঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন একটি বেসরকারিী সংগঠনের স্বাস্থ্যকর্মী লাকি আক্তার। উক্ত সভাটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের সহযোগী কর্মসূচি কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার। এবং কারিগরী সহায়তার পাশাপাশি কিশোরীদের সামাজিক সমস্যা বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন বারসিক কর্মকর্তা সুদীপ্তা কর্মকার।


আলোচনায় স্বাস্থ্যকর্মী লাকি আক্তার কিশোরীদের বিভিন্ন সমস্যার আলোকে সমাধানমূলক পরামর্শ প্রদান করে বলেন, “বয়ো:সন্ধিকালীন স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে জানতে হলে আগে জানতে হবে কোন সময়টাকে আমরা বয়ো:সন্ধিকালীন সময় বলি। সাধারণত ১০-১৯ বছর পর্যন্ত সময়কে বয়ো:সন্ধিকালীন সময় বলা হয়ে থাকে। এই সময়ে কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তন হয়। অভিভাবকদের উচিত তাদের খেয়াল রাখা। এছাড়া কিশোরীদেরও উচিত হবে তাদের মা বাবার সাথে সব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা।’

লাকি আক্তার বয়ো:সন্ধিকালীন সময়ে কিশোরীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ প্রদান করেন। এছাড়া বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি প্রচুর পানি পান করা, পরিষ্কার পানিতে গোসল করা, শাক-সব্জি, ফলমূল বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘আজকের কিশোরীরাই ভবিষ্যতে মা হবে। অতীতে অনেক ভুল ধারণা ছিল যে, বয়ো:সন্ধিকালীন ও গর্ভকালীন সময়ে কিশোরী বা নারীকে কম খাবার খেতে হবে। কিন্তু এটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ পুষ্টিকর খাবার খেলে জরায়ুর সঠিক বৃদ্ধি হয়। ফলে কিশোরীটি সুস্থ থাকে, তার কোনো ধরণের শারীরিরক সমস্যা দেখা দেয়না। আর একজন নারী সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারে।’


লাকি আক্তার আরো বলেন, ‘এই বয়সে শুধুমাত্র কিশোরী নয়, কিশোরদেরও বিভিন্ন পরিবর্তন হয়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ফলে ইভটিজিং এর মতো সামাজিক ব্যাধি দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। যে কারণে নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তোমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতে হবে। তাছাড়া সেলাই, সব্জী চাষ, গল্পের বই পড়া ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বয়ো:সন্ধিকালীন সময়ে মানসিক সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। এই ধরণের সমস্যা দৈনন্দিন কাজকে ব্যহত করে। কিন্তু এর জন্য আমাদের বিপথে গেলে চলবেনা। সৃষ্টিশীল কাজের সাথে নিজেরকে যুক্ত করতে হবে।’


করোনাকালীন সময়ে শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বাল্য বিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি কিশোরীদেরও সচেতন হতে হবে। এই বিষয়ে বারসিক ঢাকা অঞ্চলের কর্মকর্তা সুদীপ্তা কর্মকার বলেন, ‘কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রী কেউ কাউকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেনা। ফলে আমাদের সমাজে বর্তমানে ডিভোর্স এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া তোমরা (কিশোরীরা) নিজেরা যদি সঠিক পথে চলতে পারো, অভিভাবকদের বোঝাতে পারো যে বাল্য বিয়ে কোনো সমাধান নয়। তাহলে তাঁরা নিশ্চই সচেতন হবেন। তাঁরা যখন দেখবেন তোমরা রীতিমতো পড়াশোনা করছো, ঘরের কাজে সহযোগিতা করছো বা কোনো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছোনা, তখন তাঁরা নিজে থেকেই চাইবেন তোমরা পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হও।’

তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের বাবা, মাকে বোঝানোর দায়িত্ব তোমাদের। তাঁদেরকে বোঝাতে হবে যে বাল্য বিয়ের ফলে একটি মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। কারণ কিশোরী বয়সে সে যখন মা হয়, তখন তার বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। কিশোরী মা নিজের যতœ নিতে পারেনা এমনকি সন্তানের পরিচর্যাও সঠিকভাবে করতে পারেনা। স্বামী বা সংসারের চাহিদা পূরণেও ব্যর্থ হয়। তখন সে আবার বাবা, মায়ের কাছেই ফিরে আসে। ফলে পুরো পরিবারটি অসহায় অবস্থায় দিন কাটায়।’
সুদীপ্তা কর্মকার নেত্রকোণা অঞ্চলে বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ প্রদান করেন। তাছাড়া এই ধরণের আলোচনা অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র কিশোরী নয়, তাঁদের অভিভাবকদের যুক্ত করার বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং কিশোরীদের বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে যুক্ত হওয়ার আহবান জানান।


সিংহের বাংলা ইউনিয়নের আদি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা আমাদের বাবা মায়ের সাথে অনেক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে লজ্জা পাই। আমাদের এখন স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই আমরা বন্ধুদের সাথে, সহপাঠীদের সাথে বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনা করতে পারিনা। যে কারণে এই সময়ে আমরা স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছি। আমাদের সকলের উচিত কোনো সংকোচ না রেখে অভিভাবকের সাথে সব বিষয়ে আলোচনা করা। আর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নেয়া।’


ধলাই পাড়ের কিশোরী সংগঠনের সদস্য রুনা আক্তার বলেন, ‘নিজেদের সচেতন হওয়ার সাথে সাথে আমাদের অভিভাবকদেরকেও সচেতন করে তুলতে হবে। তাঁদেরকে বোঝাতে হবে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিলে মেয়েদের কত ধরণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে হবে। কোনো খারাপ কাজ বা ভিন্ন পথে যাওয়া যাবেনা। সঠিক পথে চলতে হবে। লজ্জা নয়, নিজেদের সচেতনতাই পারে আমাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে।’

উল্লেখ্য, আলোচনা সভার শুরুতে খাদিজা আক্তার অনুষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর কিশোরীগণ একে একে তাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সমস্যাসমূহ তুলে ধরেন।

happy wheels 2

Comments