পাহাড়ি বালু থেকে ফসল রক্ষায় আমি আগামীতে বস্তায় সব্জি চাষ করবো

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
বারসিক’র উদ্যোগে সম্প্রতি পাহাড়ি বালু ও ঢল থেকে ফসল রক্ষায় বস্তা পদ্ধতিতে ফসল চাষ বিষয়ক একটি অনলাইন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় অংশগ্রহণ করেন সীমান্তবর্তী এলাকার বস্তা পদ্ধতিতে সব্জি চাষ করছেন এমন কৃষক কৃষাণীবৃন্দ। এছাড়াও যুক্ত ছিলেন হাওরের কৃষক কৃষাণী নেত্রকোনা অঞ্চলের বারসিক’র সকল কর্মকর্তা কর্মচারী বৃন্দ এবং ঢাকা অঞ্চল থেকে বারসিক’র পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস, সঞ্চালনা করেন কর্মসূচী কর্মকর্তা গুঞ্জন রেমা।


অনলাইন সভার প্রারম্ভে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান। শুভেচ্ছা বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি বালু, ঢল ও জলাবদ্ধতা থেকে শাকসব্জি রক্ষার জন্য মানুষ তার নিজ তাগিদেই নানা ধরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে বস্তা পদ্ধতি একটি। যার ফলে পাহাড়ি ঢল বা পাহাড়ি বালু থেকে চাষকৃত সব্জিগুলো রক্ষা করা সম্ভব যা আপনাদের (কৃষক কৃষাণী) মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে। আপনাদের এমন উদ্যোগুলো আরো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে এটা সকলের কাছে প্রত্যাশা।’

২০১২ সাল থেকে বস্তায় সব্জি চাষ করছেন তারানগর গ্রামের মথি ঘাগ্রা। তিনি তার অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বর্ষা মৌসুমে বস্তায় মাটি ভরে বারোমাসী মরিচ, চালকুমড়া, শশা, ঝিঙ্গা চাষ করি। এর ফলে অতি বৃষ্টিতেও সব্জি গাছের কোন সমস্যা হয়। বস্তায় সব্জি চাষ করলে পরিচর্যা করতেও সুবিধা। আবার প্রয়োজনবোধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করাও সহজ। বর্ষাকালে মরিচের দাম বেশি থাকে কারণ অতি বৃষ্টির কারণে মরিচ গাছগুলো মরে যায়। কিন্তু বস্তায় মরিচ চাষ করার ফলে আমার মরিচ গাছগুলো মরে না।’ সাবিনা রংদী বলেন, ‘আমি প্রতিবছরই বস্তায় মরিচ, শীম, শশা চাষ করতাম কিন্তু এবার অসুস্থতার কারণে বস্তায় সব্জি চাষ করতে পারি নাই। এবার সরাসরি মাটিতেই রোপণ করেছিলাম কিন্তু একটা মরিচ গাছও আর রক্ষা করতে পারলাম না। বিগত বছরগুলোতে বস্তায় মরিচ গাছ রোপণ করতাম তখন বর্ষা মোৗসুমে মরিচের দাম বেশি হলেও বাজার থেকে কিনে খেতে হতো না।’


সুবিমল ম্রং বলেন, ‘আমি বেনুকা ম্রং এর বস্তায় সব্জি চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এবার নিজেই বস্তায় সব্জি চাষ শুরু করেছি। বস্তায় বরবটি, শীম, মরিচ, শশা রোপণ করেছি। আমি যে স্থানে বস্তায় সব্জি চাষ করেছি সেটি বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল হলে পানি উঠে সব কিছু নষ্ট হয়ে যেত। এবার বস্তায় সব্জি চাষ করার ফলে কোন সব্জি গাছ মরে যায়নি। বস্তা পদ্ধতিতে সব্জি করে এর উপকারিতা আমি এ বছর উপভোগ করছি।’ মদন উপজেলার হাওর অধ্যষিত এলাকার নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমাদের হাওর অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে কোন শাকসব্জি চাষ করতে পারতাম না পানির জন্য। বর্ষা মৌসুমে পানি হাওরে পানি আসলে আবার বৃষ্টি বেশি হলে সব শাকসব্জির গাছ মরে যেত। কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে বস্তায় সব্জি চাষ করছি এবং লাভবানও হচ্ছি। এ পদ্ধতিতে সব্জি চাষ করলে পানি আসলে অথবা বেশি বৃষ্টি হলেও সব্জি গাছ মরে না। এ বছর আমি চালকুম্ড়া ঝিঙ্গা বিক্রি করেছি। জো¯œা বেগম বলেন, আমি বস্তায় সব্জি চাষ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না মুন্না দি আমাকে বলছে বস্তায় সব্জি চাষ করলে নাকি অতি বৃষ্টিতেও কিছু হয় না। আমি আগামীতে বস্তায় সব্জি চাষ কবরো।’


বস্তা পদ্ধতিতে সব্জি চাষের যে প্রক্রিয়া সে সম্পর্কে সম্মক ধারণা দেন সহযোগী সমন্বয়কারী শংকর ম্রং তিনি বলেন, ‘বস্তায় সব্জি চাষ করার জন্য আপনারা যে পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন সেগুলো খুবই সুন্দর। তার সাথে আমি কিছু বিষয় যুক্ত করতে চাই, যেমন বস্তা নির্বাচন সিমেন্টের খালি বস্তা খুবই ভালো। কারণ অন্যান্য বস্তাগুলো রোদে পুরে বৃষ্টিতে ভিজে সহজে নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু সিমেন্টর খালি বস্তা অনেক দিন টিকে। প্রথমে মাটির সাথে জৈব সার ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে তার পর অন্তত পক্ষে ১৫ দিন মাটি জাগ দিয়ে রাখতে হবে। মাটির সাথে কখনোই কাচা গোবর ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্যই পচা গোবর দিতে হবে। যখন বস্তায় মাটি ভরা হবে তখন বস্তা ৪টি ভাগে ভাগ করে ৩ ভাগের মধ্যে মাটি ভরাট করতে হবে এক ভাগ খালি রাখতে হবে যাতে করে পরবর্তীতে গাছের গোড়ায় জৈবসার প্রয়োগ করা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গাছের মধ্যে যখন ফুল ধরা শুরু হবে তখন গাছের গোড়ায় পরিমাণ মত জৈব সার দিতে হবে। অতি খরা বা শুষ্কতা থেকে রক্ষার জন্য মালচিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ গাছের গোড়ায় পচা খড় দিতে হবে যাবে গাছের গোড়া ঠান্ডা থাকে এর জন্য। এছাড়াও বস্তার নিচ দিকে ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে করে পানি চলে যেতে পারে। আলো বাতাস যাতে ঐ ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বস্তা স্থাপন বা রাখার ক্ষেত্রে বালুতে যদি হয় তবে বস্তা ৩ ভাগের মধ্যে এক ভাগ মাটি গর্ত করে পুঁতে দিতে হবে। আর যদি হাওরে হয় তবে ৩ ফুট পানি হলে ৪ ফুট উচ্চতায় মাচা তৈরি করে বস্তা রেখে দিলে কোন সমস্যা হবে না। যদি এমন কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলেন তবে বস্তায় সব্জি চাষের ক্ষেত্রে কোন ধরণের সমস্যা হবে না। ‘
উল্লেখ্য, কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে রয়েছে নানা সমস্যা এর মধ্যে প্রধান সমস্যগুলো হলো বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢল ও পাহাড়ি বালু আবার শুকনো মৌসুমে পানির সংকট। পাহাড়ী ঢল হলে সীমান্ত বর্তী এসব গ্রাম গুলি কয়েক ঘন্টার জন্য প্লাবিত হয়ে যায়। যার ফলে চাষ করা শাকসব্জিগুলি নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবছরই এমন ঘটনা ঘটে বছরে কয়েকবার ফলে বর্ষা মৌসুমে শাকসব্জি আবাদ করা খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য পরীক্ষামূলক বস্তায় সব্জি চাষ শুরু করেন এখানকার স্থাণীয় কৃষক গণ। এমন করে কলমাকান্দা উপজেলার ১৭টি পরিবার বস্তায় সব্জি চাষ করে সুফল পেয়েছে। তারা বস্তায় চাষ করেন, বারোমাসী মরিচ, বেগুন, শশা, কুমড়া, পুইশাক, টকপাতা, শীম, বরবটি ইত্যাদি। এসব সব্জি বস্তায় চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেক কৃষক। তাদের দেখা দেখি অনেকে এখন বস্তায় সব্জি চাষ শুরু করছেন।

happy wheels 2

Comments