হেলিকপ্টারে জীবন চলে

সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বাবলু জোয়ারদার

হেলিকপ্টার! শুনলে মনে হবে সে তো আকাশপথে চলে। কিন্তু না এই হেলিকপ্টার চলে সড়ক পথে। এই সাইকেল চালিত হেলিকপ্টার সাতক্ষীরার ঐতিহ্য বহন করে। আজ থেকে বিগত কয়েক দশক পূর্বে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় দেখা যেত এই সাইকেল হেলিকপ্টার। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাইকেলের পিছনে ছিট বেধে হেলিকপ্টার তৈরি করে মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেত চালক। কিন্তু বর্তমানে কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক বাহন বিকাশের কারণে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের ঐতিহ্য হেলিকপ্টার। এখন এলাকায় আর আগের মত আর হেলিকপ্টার দেখা যায় না। এক রকম নেই বললেই চলে।

ঐতিহ্যের সেই সাইকেল হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষদেরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিজের পেশাটাকে কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছেন শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম পোড়াকাটলা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক গাজী (৫১)। তিনি দীর্ঘ ৩২ বছর এই হেলিকপ্টার চালিয়ে সংসার নির্বাহ করছেন। একসময় এই এলাকা কৃষিতে সমৃদ্ধ ছিল কিন্তু কালের পরিক্রমায় মানুষ অধিক লাভের আশায় কৃষিকে দুরে সরিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করে।

চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার আগে এই এলাকার মানুষ মূলত কৃষি কাজ করত। এই রকম এক গরীব কৃষি পরিবারে আব্দুর রাজ্জাক গাজীর জন্ম। তিন ভাই, তিন বোন নিয়ে ছিল তাদের সংসার। সংসারের অভাব অনটনের জন্য তিনি আর বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। তিনি সবার বড় হওয়ার কারণে সংসারের চাপ এসে পড়ে তার উপর। বাবার উপর চাপ কমানোর জন্য বাবার সাথে তিনি কৃষি কাজে নেমে পড়েন। শুরু হয় তার পথচলা। এই পথ চলার পথে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তার শারীরিক সমস্যা। হঠাৎ একদিন গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার কোমরে ব্যথা লাগে। ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার তাকে ভারী কাজ না করার উপদেশ দেন। তখন তিনি দিশেহারা হয়ে কি করবেন কিভাবে সংসার চলবে এমন চিন্তা করতে করতে দেখা হয় একই গ্রামের হেলিকপ্টার চালক আবুল মোল্লার সাথে। তিনি হেলিকপ্টার চালিয়ে তার সংসার চালাতেন। তাকে তিনি হেলিকপ্টার চালানোর পরামর্শ দেন। তখনও তিনি সাইকেল চালাতে পারতেন না। এরপর আস্তে আস্তে সাইকেল চালানো শেখেন। প্রথমে ছোট বাচ্চাদের পিছনে বসিয়ে চালানো শেখেন।

এবার আবার এক নতুন জীবন যুদ্ধে নামার পালা। সাইকেল কেনার জন্য বাবার কাছে টাকা চাইলে তিনি দিতে না পারায় পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে একটি সাইকেল কেনেন। তিনি সাইকেলের পিছনে কাঠ ও ফোম দিয়ে গদি তৈরি করে বেঁধে হেলিকপ্টার নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। সেই থেকে নতুন এক পেশার সাথে যুক্ত হন আব্দুর রাজ্জাক গাজী। হেলিকপ্টার চালিয়ে নিজের দুই বোনকে বিবাহ দিয়েছেন আর নিজে ও বিয়ে করেছেন। দুই ছেলেসহ তার ছয় জনের সংসার। আগে হেলিকপ্টার চালিয়ে বেশ আয় হত। তা দিয়ে তার সংসার ও ছেলেদের পড়ালেখা ভালোভাবে চলত। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন যান্ত্রিক বাহন আসতে শুরু করে। আয়ও কমে যায়। আয় কম হওয়ার ফলে বড় ছেলেকে আই এ পাশ করানোর পর অভাবের জন্য পড়ালেখা না করিয়ে কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। আর ছোট ছেলে বর্তমানে অনার্স হয় বর্ষে পড়ে।

এই পেশায় বর্তমানে আয় কম হলেও তিনি পেশাটাকে এখনো পর্যন্ত ধরে রেখেছেন, ধরে রেখেছেন এলাকার ঐতিহ্যকে। আগের মত আর আয় হয়না। ইঞ্জিন চালিত বাহন আসার ফলে তার হেলিকপ্টারে লোক উঠতে চায় না। অনেক সময় লাগে। এই প্রসংগে আবদুর রাজ্জাক গাজী বলেন, ‘আগে রাস্তাঘাট এত ভালো ছিল না,ইঞ্জিন চালিত বাহনও কম ছিল সে কারণে সাইকেল চালিত হেলিকপ্টারের চাহিদা ও প্রচলন ছিল কিন্তু বর্তমানে রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন, ইঞ্জিন চালিত মটর সাইকেল, ইজিবাইক, মটর ভ্যান ইত্যাদি আসায় আমার সাইকেল চালিত হেলিকপ্টারে খুব বেশি মানুষ উঠেনা। বর্তমানে আমি কলবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ বাজারের থেকে বাজার করা জিনিসপত্র বাড়ি পৌছে দিই। তাতে যে টাকা পাই তাই দিয়ে কোন রকমে চলি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বয়স বেড়ে যাচ্ছে শরীরের শক্তিও কমে যাচ্ছে তাই আর ঠিকমত পেটল করতে পারিনা। সমাজের সহৃদয়বান কোন মানুষ যদি সাইকেলে মটর বসানোর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে এই পেশাটাকে টিকিয়ে রাখতে এবং সংসার চালাতে পারতাম।’

নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তির মধ্যে বিগত সময়ের মানুষের চলাচলের বাহনটি টিকিয়ে রাখি এবং এলাকার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি।

happy wheels 2

Comments