আমাদের কথা এখন কেউ মনে রাখে না

মানিকগঞ্জ থেকে ঋতু রবি দাস
বারসিক’র সাথে জড়িত হওয়ার পর বেইজ লাইন করতে যাই মানিকগঞ্জের আন্ধারমানিক গ্রামে। একটা নির্জন জায়গায় বাঁশ আর কাঠ গাছ দিয়ে ঘেরা একটি মাত্র বাড়ি দেখতে পাই। দেখলেই গা ছমছম করে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ। ভয়ে ভয়ে গেলাম সেই বাড়িতে, গিয়ে বললাম বাড়িতে কেউ আছেন, ভিতর থেকে একটা বয়স্ক নারীর কন্ঠ শুনে ভয়টা একটু কমলো। ভিতরে গিয়ে দেখি একজন বয়স্ক নারী সেলাই মেশিনে কাজ করছেন। তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি বসার পরই নিজে থেকেই অনেক কথা বলা শুরু করলেন, এবং তাঁর হাতের তৈরি বাঁশের ঝুঁড়ি আমাকে দেখালেন। তার নাম জিজ্ঞেস করাতে বললেন আমার নাম শিরিন, বয়স ৬৫। তাঁর সাথে অনেক্ষণ কথা বললাম, আসার সময় তার নিজের হাতের তৈরির ছোট বাঁশের ঝুঁড়িটি আমাকে দিয়ে দিলেন। আমিও অনেক খুশি হলাম সেটা পেয়ে।
অনেক দিন ধরে সেই নারী বাড়িতে যেতে চাইতাম, কিন্তু হয়ে উঠত না, তার বাড়ির রাস্তাটা ভুলে গিয়েছিলাম। প্রথমদিন তাঁর সাথে কথা বলার পর থেকেই তার প্রতি কৌতূহল ছিল আমার অনেক বেশি। তার কথাগুলো আমাকে খুবই ভাবাতো। অবশেষে সম্প্রতি মাহিয়া,তাহিয়া এবং সুমাইয়াদের নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হই। মাহিয়া, তাহিয়া এবং সুমাইয়ার বাড়ি সেখান থেকে একটু দূরে। আর এককথায় গ্রামের সব মানুষরাই তাদের চিনে।


প্রায় ১০ মাস পর তার বাড়িতে যাই, আমি বললাম আমাকে চিনছেন, আমি মাস্ক খুলতেই বললেন চিনছি। একটু কথা বলার পরই বললাম তিনি এতদিন পরও আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন। তিনি বললেন যে, আমি তো তোমার মুখ দেখে চিনি নাই, আমি তোমার কণ্ঠ শুনেই তোমাকে চিনেছি। আমি বিস্মিত! এই বয়সেও যে তার স্মরণশক্তি এত আমি সত্যি অবাক করার মতো। আমি বললাম, আপনার জীবন কাহিনী একটু বলেন আমি শুনব। তিনি বলতে শুরু করলেন।

তার বাবার বাড়ি হচ্ছে বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন এবং ঘিওর থানা। তাঁরা ৪ বোন ৪ ভাই ছিলেন। ২ ভাই মারা গেছেন। তিনি গোষ্ঠীর ভাই বোনদের মধ্যে সবার চাইতে বড়। তিনি বলেন, ‘আমার ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়, তোমার চাচার নাম গোলাম মোস্তফা (৭০)। আমার দুই ছেলে। মেয়ে নেই। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর (৩৫), ছোট ছেলে আহাদুল (২৫)। বড় ছেলের ঘরে এক ছেলে এবং এক মেয়ে। দুই ছেলেই বার্নিশের কাজ করে।’

তিনি বলতে থাকলেন, ‘তোমার চাচা সিভিল সার্জন অফিসে চাকরি করতেন। সামনে যে মসজিদটা দেখছ তার আগের জমিগুলোই আমাদের ছিল। ৭ ডিসিমিল (শতাংশ) জমি ছিল। দুই ধাপে জমিগুলো বিক্রি করে দেন তোমার চাচা।’ জানতে চাইলে বলেন, ‘তোমার চাচার স্ট্রোক হয়েছিল চিকিৎসার জন্য বিক্রি করেছিল। অসুস্থতার কারণে অবসর এর আগেই তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। তোমার চাচা যখন চাকরি করতেন মহল্লার সবাই আমাদের কাছে আসত। কারো কোন দরকার পরলেই সবাই বলত হিরুর মায়ের কাছে চল (তার বড় ছেলের ডাকনাম হিরু)। সবার বিপদে আপদে আমরা সাহায্য করেছি, কাউকে কোনদিন নিরাশ করিনি। মহল্লায় কারো বিয়ে পড়লে আমারে আইসা বলত, হিরুর মা বিয়ার মধ্যে তুমি এই জিনিসটা দিবা। আমরা মানা করি নাই। আমরা দিছি।’ তিনি কষ্টভরে মনে বললেন, ‘কিন্তু আমাগো কপাল খারাপ। তোমার চাচা পেনশনের সব টাকা তুইলা নিছিল। তারপর সেই টাকা দিয়া বেবি ট্যাক্সি কিনে ভাড়া দিছিলাম, গাড়ি শুধু এক্সিডেন্ট করত তাই বিক্রি কইরা দেই। গাড়ি বিক্রি করে আমরা তিনটি গরু কিনি। প্রত্যেক গরু গুইলা প্রতিদিন ১০-১২ কেজি করে দুধ দিত। সেই দুধ আমরা খাইতাম। হাতের কব্জি ডুবাইয়া দুধ ভাত না খাইলে মনে হয়না দুধ ভাত খাইছি। দুধ আমরা বিক্রি ও করতাম এবং বেশির ভাগ মাইনসেরে আমরা মাগনা দুধ দিতাম। কিন্তু দুঃখ আমাগোর পিছু ছাড়ল না, গরু গুইলাও মইরা গেল। আমাগো জায়গা জমির অভাব আছিল না, টাকা পয়সার অভাব আছিল না, যে যখন যা চাইত সব দিতাম। আমাগোর উপকারের কথা এখন কেউ মনে রাখে নাই। যখন দিবার পারছি ভালো আছিলাম, সবাই আমাগো বাসায় আসত, সবাইরে দুধ চা বানাইয়া খাওয়াইতাম, কত সুখের দিন আছিল। এখন আমরা মানুষের জায়গায় আছি, না জানি কবে উঠাইয়া দেয়। মানুষের জন্য অনেক করছি তাই আামাগো নিজের জন্য কিছুই নাই।’

তিনি ও তাঁর স্বামীর দুই জনেরই ভোটার আইডি কার্ড আছে। কিন্তু তারা কোন বয়স্ক ভাতা পান না।বর্তমানে দুই ছেলের রোজগারেই সংসার চলে তাদের। যেদিন গেলাম সেদিন চাচি পোলাও আর মাংস রান্না করছিলেন, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম চাচি একটা পাতিল চুলায় রেখে গরম করে নামিয়ে পোলাওটা ঢেলে রাখলেন। মাংসটাও একইভাবে অন্য একটা গরম হাড়িতে ঢেলে রাখলেন। কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, এইভাবে রাখার কি কোন কারণ আছে, তিনি বললেন, ‘এইভাবে ভাত মাংস রাখলে ভালো থাকে। এত বছর আমি তরকারি রান্না করি কিন্তু কোনদিন আমার তরকারি গন্ধ হয়না। আমি নতুন একটা পদ্ধতি জানলাম তাঁর কাছ থেকে।
বয়সের তুলনায় তিনি অনেক কর্মঠ, সব কিছুই নিজের হাতে করেন। নিজের আর নাতনীর জন্য পোশাক নিজেই বানান। চোখে ভালোই দেখেন। বন্যার সময় তাঁর বাড়িতে অনেক বড় দুটো সাপ ঢুকেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সাপটাকে মারেননি? তার সহজ সরল উত্তর, ‘তারা তো আমাদের কোন ক্ষতি করেনি, আমরা কেন করবো? তারা নিজেরাই বের হয়েগিয়েছিল।’ জানতে চাইলাম, আপনাদের কাউন্সিলর আপনাকে কোন ভাতা কেন দিচ্ছেন না, তিনি অভিমানের সুরে বললেন, ‘সে আমাদের চোখে দেখে না।’

জানিনা কোনদিন তাদের উঠে যেতে হবে, তারা যদি সরকারি আবাসন পেত তাদের জন্য অনেক ভালো হত। বয়স্ক ভাতা পেলেও অনেক উপকার হতো তাদের। যেই গ্রামে তিনি থাকেন, সবার মুখেই তাদের প্রশংসা শুনলাম, কেউ তাদের খারাপ বলেনি, অনেক ভালো কাজ করলে তবেই এমন প্রশংসিত হওয়া যায় আমার ধারণা। শিরিনের মত সহজ সরল মানুষগুলো বেঁচে থাকবেন সবার অন্তরে। অনেক বছর বেঁচে থাকুন আপনি।

happy wheels 2

Comments