আসুন আমরা কীটনাশককে ‘না’ বলি

সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে সঞ্চিতা কীর্তুনীয়া
২০২১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে জনগোষ্ঠী পর্যায়ে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে তালিবপুর ৪টি ও বায়রা ইউনিয়নের ৬টি মোট ১০টি গ্রামের ৫০ জন কৃষকের একটি জরিপ করা হয়। ১৪৪টি প্রশ্নমালার উপর ভিত্তি করে জরিপ কার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রশ্নমালায় কীটনাশক সমন্ধীয় বহু প্রশ্নের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ছিল এমন যে, ‘আপনি কোথায় কীটনাশক সংরক্ষণ করেন? সেগুলো কী বাচ্চাদের থেকে দূরে রাখা হয়? কীটনাশকের পাত্র কি গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা হয়। সেখানে ৫০ জন কৃষকের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই রকম উত্তরই পাওয়া গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন কীটনাশক মাঠে সংরক্ষণ করা হয়, বাচ্চাদের থেকে দূরে রাখা হয় এবং গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করা হয় না। আবার কেউ কেউ এটাও বলেছিলেন যে কীটনাশক থাকার ঘরে বা বাড়িতে সংরক্ষণ করা হয়, সেগুলো বাচ্চাদের হাতের কাছেই থাকে এবং গৃহস্থালী কাজে কীটনাশকের পাত্র ব্যবহার করা হয়। তেমনই একজন ব্যক্তি বাঘারচর গ্রামের কৃষক গণেশ মন্ডল ও তার স্ত্রী ঝর্না রানী।

সম্প্রতি বাঘারচর গ্রামে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করি সেই কৃষক গণেশ মন্ডল (৪৭) এর সাথে। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি ভ্যান গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন মেয়ে চন্দনা মন্ডল (২২) কল্পনা মন্ডল (১৫) কাকলী মন্ডল (১২) আর এক ছেলে নয়ন মন্ডল (৬) এবং স্ত্রী ঝর্না রানী মন্ডল (৩৫) কে নিয়ে তাঁর সংসার। অভাব অনটনের কারণে বড় মেয়ে চন্দনাকে বিয়ে দিয়েছেন মাধ্যমিক পাস করার আগেই। মেজ মেয়ে কল্পনা পড়াশোনা করে দশম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে কাকলী ষষ্ঠ শ্রেণিতে।


সমাজের চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী ছেলে সন্তানকে ভাবা হয় পরিবারে সবার ছোখের মণি হিসাবে। তিন মেয়ের পর গনেশ মন্ডলের ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ায় ভালোবেসে তার নাম রাখা হয় নয়ন। দেখতে সুদর্শন নয়ন মন্ডল সবার চোখের মণি হয়ে জন্ম নিলেও এতো দুর্ভাগ্য নিয়ে সে জন্ম গ্রহণ করবে সেটা কেউ ভাবতেও পারেনি। ৬ বছরের নিষ্পাপ শিশু নয়ন মন্ডল মানসিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে। এই বয়সে যখন তার ছুটে চলার কথা সেখানে সে পরিবারের সাহায্য ছাড়া উঠে দাঁড়ানোর কথাও ভাবতে পারেনা। বাবা, মা, দিদি বলে আধো আধো কন্ঠেও ডাকতে পারেনা। তার এই স্থবিরতা তার পরিবারের কাছে কতটা কষ্টদায়ক সেটা শুধু তারাই অনুভব করতে পারেন। অভাব অনটনের কারণে ছেলের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে পারছেন না গণেশ মন্ডল।
এত সব কষ্টের পরও পরিবাবের ভুলের কারণে তার (নয়ন) জীবনে ঘটে গেছে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। জানতে পারলাম ৩-৪ দিন আগে ঘরের কোণে রেখে দেওয়া গণেশ মন্ডলের কৃষি কাজে ব্যবহার করা বিষ (ফুড়াডান) তার হাতের নাগালে ছিল এবং অবুঝ মনে সে সেটা খেয়েছিল! তারপর তার মা সেটা বুঝতে পারে এবং তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে পেট ওয়াশ করে অনেক কষ্টে তাকে বাচাঁনো গেছে। অভাবের সংসারে তার চিকিৎসার জন্য খরচও হয়েছে অনেক।


আমরা মনে করি, এই ভয়ানক ঘটনার জন্য দায়ী কীটনাশক এবং কীটনাশক ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের অসচেতনতা। কেন আমরা এতোটা অচেতন কীটনাশক সম্পর্কে? আমাদের একটু অসচেতনতা ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছিল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় কাতর বাবা মায়ের নয়নের মণি নয়ন মন্ডলের নিষ্পাপ জীবনটা। যেখানে কীটনাশকের বোতলের গায়েও লেখা থাকে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন কিন্তু আমি আপনি কেউই এতটুকু সচেতন নই বলে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নয়ন খেয়ে ফেলল ফুড়াডান। কে বলতে পারেন তার এই শারীরিক এবং মানসিক সমস্যায় এই বিষের প্রভাব আরও কোন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে না?


তাই এখনও সময় আছে আসুন সচেতন হই এবং সবাইকে সচেতন করি কীটনাশকের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়ে। আসুন প্রতিজ্ঞা করি, আমরা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করবো এবং ব্যবহৃত কীটনাশক নিরাপদে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখবো। যদি সম্ভব হয় আসুন আমরা কীটনাশককে ‘না’ বলি!

happy wheels 2

Comments