সাম্প্রতিক পোস্ট

মনোরমা আজিমের কৃষিবাড়ি

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা মনোরমা আজিম। স্বামী, এক ছেলে, ২ মেয়ে এবং ৩ জন নাতী-নাতনী নিয়ে মনোরমা আজিমের সংসার। দীর্ঘসময় ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সংসার চালাতে স্বপরিবারে ঢাকায় ছিলেন। তারপর স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে এখন বাড়িতেই থাকেন স্বামী স্ত্রী দুজনে। ছেলে মেয়েরা এখনো ঢাকায় থাকেন। বাড়িতে থেকে এখন স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে বাড়ির চারপাশে গড়ে তুলেছেন একটি বাগানবাড়ী। বসতভিটা ৩২ শতাংশ, আবাদী জমি ৪৮ শতাংশ এবং পুকুর ১২ শতাংশ জমি রয়েছে তাদের।


বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি চাষ করেছেন। বাড়ির আশপাশে কোন জায়গা খালি নেই সবখানে ফলের গাছ ও শাকসব্জির গাছে ভরে গেছে। মৌসুম অনুসারে যেসব শাকসব্জি চাষ করে থাকেন সেগুলো হলো, ডাটাশাক, লালশাক, পুইশাক, কলমীশাক, মরিচ, ধুন্দল, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, সীম, বরবটি, বেগুন তিন জাতের, শশা, কচু, টকপাতা, কাচাকলা, মিষ্টি আলু, শিমুল আলু, পেঁপে ইত্যাদি। এসব শাকসব্জি চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেন এবং বিক্রিও করেন। সব্জি বিক্রি করতে কোন সম্যায় পড়তে হয় না। বাড়িতে ও বাজারে এসব শাকসব্জি বিক্রি করা হয়। নিজেই বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। বারোমাসি বেগুন সারাবছরই হয় এবং সারাবছরই বিক্রি করেন। ধাপে ধাপে একটা শেষ হলে আরেকটা চাষ করেন। বাড়ির কোন অংশ ফেলে রাখা হয় না। সব্জি বিক্রি করে প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করা হয়। মাঝে মধ্যে বেশিও হয়। প্রতিবছরই প্রচুর পরিমাণে সীম বিক্রি করা হয়। কিছু সীম আছে যা মৌসুমের শেষের দিকে পাওয়া যায় সেগুলি তিনি বেশি দামে বিক্রি করে থাকেন। তিনি প্রায় মাঝে মধ্যে ঢাকায় শাকসব্জি নিয়ে বিক্রি করেন কিছু পরিচিতজনদের কাছে।


আদিবাসী খাদ্যও তিনি চাষ করেন তার বাড়ীতে যেমন টকপাতা, ফানেট (একধরণের তুলসী) রাম তুলসী, তিত বেগুন, লাল বাসক ইত্যাদি। এগুলো তিনি নিজে খান এবং কিছু ঢাকায় জাবা নামের একটি আদিবাসী রেস্তোরায় নিয়ে বিক্রি করেন। তিত বেগুন, লাল বাসক, ফানেট, টকপাতা, টকপাতার ফলের খোসা আর বিন্নি ধানের চালের চাহিদা বেশি বলে জানান। এগুলো নিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। চাহিদার তুলনায় এসবের যোগান কম বলে জানান তিনি। জায়গা বেশি থাকলে এসব আদিবাসী খাবারগুলোর বাগান করার ইচ্ছা ছিল বলে জানান। বাড়ির চারপাশ বেড়া দেওয়া হয়েছে লালবাসক গাছ দিয়ে একদিকে বেড়াও হল আবার অন্যদিক খাবারও হলো। লাল বাসকের ফুল আলু দিয়ে ভেজে খাওয়া হয় অথবা আদিবাসী পদ্ধতিতে খারি (তেল মসলা ছাড়া আদিবাসী রন্ধন প্রণালী) খাওয়া হয়। আবার বাসকের ফুল রোদ্রে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে তা জাবা রেস্তোরায় বিক্রি করা হয়। শুধু যে জাবা রেস্তোরাতেই বিক্রি করা হয় এমন না। অন্যান্যদের মাঝেও তিনি এসব আদিবাসী খাদ্যগুলো বিক্রি করে থাকেন। তিত বেগুন ২০০ টাকা কেজি, টকপাতা, ১২০ টাকা কেজি, ফানেট ২০০ টাকা কেজি, বিন্নি চাল ১০০ কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন। বিন্নি চাল নিজে উৎপাদন করেন না কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিক্রি করেন বলে জানিয়েছেন।


মুরগী পালন করেন নিজের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য মাঝে মধ্যে বিক্রিও করেন। ৯টি মুরগি আছে, যা পর্যায় ক্রমের একটা পর একটা ডিম দিচ্ছে বাচ্চা ফোটাচ্ছে। পুকুরে মাছ চাষ করা হয়। সেটিও এখন শুধু নিজের চাহিদা পূরণের জন্য। তবে এক সময় বাণিজ্যিকভাবে মাছ করার পরিকল্পনা আছে।


শাকসব্জি চাষ করছেন আবার বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণও করছেন। লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ডাটা, চালকুমড়া, টকপাতা, ফানেট, রাম তুলসী, সীম, বেগুন, পেঁপের বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করছেন। সংগৃহীত বীজ নিজে রোপণের পর অন্যান্যদের মাঝে বিতরণ করেন।


ফলের মধ্যে আছে লিচু, আম, কাঠাল, জাম্বুরা, লটকন, কলা, লেবু, আমড়া, আতাফল, ইত্যাদি। এর মধ্যে পেঁপে, কলা ও লেবু বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে বাকীগুলো এখনো বিক্রি করার মত ফল হয় নাই। লিচু রোপণ করার পরের বছর থেকেই খাওয়া হচ্ছে। একটা বারোমাসী আম গাছ আছে সেখানে সারাবছরই একের পর এক আমফুল হচ্ছে বড় হচ্ছে, পেকে যাচ্ছে এমনটি দেখা যায়। পেপে গাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে পেঁপে পাওয়া যায়। কাঁচা ও পাকা দুইভাবেই পেঁপেগুলো বিক্রি করা হয় তবে পাকা পেঁপেতে দাম বেশি পাওয়া যায় বলে জানান।


পুকুর পাড়ে ৩ জাতের কলা, মিষ্টি আলু, টকপাতা চাষ করেছেন। মাঝে মাঝে লাউ গাছ রোপণ করেছেন। আর পুকুরের দিকে মাচা তৈরি করে দিয়েছেন। ফলে পুকুর পাড়টাও ঠিকমত ব্যবহার হলো আবার পুকুরের কিছু জায়গাও ব্যবহার হলো। এভাবে প্রতিটি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন মনোরমা আজিম। আগামী বছর কিছু জায়গা মাটির তোলার বাকি আছে সেটিও মাটি ভরাট করবেন সব্জি চাষ করার জন্য বলে জানান। এভাবে প্রতি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তার জন্য তিনি নিজেকে খুবই সুখী মনে করেন। এখন গ্রামের মধ্যে সব্জি চাষকারী বা উৎপাদনকারী বাড়ি হিসেবেও বেশ পরিচিতি পেয়েছে তার বাড়ীটি।

happy wheels 2

Comments