সাম্প্রতিক পোস্ট

মেলে মাদুরে ললিতাদের জীবন সংগ্রাম

আসাদুল ইসলাম, আশাশুনি, সাতক্ষীরা
ললিতা মন্ডল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের সাথে সংগ্রাম করে জীবনযুদ্ধের সাথে টিকে থাকা একজন সংগ্রামী নারী। স্বামী সন্তান নিয়ে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার সদর ইউনিয়নের নাটানা গ্রাম বসবাস করছেন তিনি। নোনা পানি আর পর্যাপ্ত কাজের অভাবের মধ্যেও সংগ্রাম করছেন। বাপ-দাদার আদি পেশা মেলে মাদুর বুনে জীবন যুদ্ধে কোন রকম টিকে আছেন ললিতা মন্ডল ও তার পরিবার।
২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা আর সর্বশেষ ২০২০ সালের আম্পান ললিতাদের সংগ্রামকে তিতো করে দিয়েছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা এবং ২০২০ সালের ১৩ মে আম্পান ললিতাদের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। জলাবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘনঘন এসব ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলের স্বাভাবিক জীবনকে অতিষ্ট করে দিয়েছে। এক সময়ের সুন্দর প্রকৃতি এখন নোনা জলের কাব্য। কৃষি, বাড়ির আঙিনায় সবজি, কৃষি ক্ষেত-খামারে পর্যাপ্ত কাজ আর নদীতে মাছ ধরে সুন্দরভাবেই চলতো ললিতাদের জীবন। কিন্তু দ্রুতই বদলাতে থাকে তাদের জীবন। নোনা পানির মাছ চাষ আর নোনা পানি-মাটির ফলে পর্যাপ্ত ফসল না হওয়ায় কাজহীন হতে থাকে ললিতাদের। কোন উপয়ায় না পেয়ে বাপ-দাদার আদি পেশা মেলে-মাদুর বুনে কোন রকম টিকে আছেন তারা।


কাজের অভাবে ললিতার একমাত্র সন্তান থাকে ভারতে। সেখানে দিনমজুরের কাজ করেন। স্বল্প মজুরিতে ললিতার স্বামী কাজ করেন অন্যের মৎস্য ঘেরে। অভাবের সংসার তাই ললিতাকেই হাল ধরতে হয়েছে। বাপ-দাদার আদি পেশা মেলে-মাদুর বুনছেন তিনি। তবে সেখানেও জলবায়ু পরিবর্তনের থাবা। আগের মত মেলে উৎপাদন হয় না। তাই দূর থেকে মেলে আনতে হয় সেখানেও খরচ বেশি। ফলে লাভের পরিমাণ কমে গিয়ে কোন রকম চলছে এই পেশা। তাতে আবার প্লাস্টিকের মাদুর ওঠায় মেলে মাদুরের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে মেলে-মাদুরেও তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
ললিতা মন্ডল জানান, জলাবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। নোনা জলের খেলা চলে। আগের মত ক্ষেত-খামার হয় না ফলে কাজও কম। এজন্য বাপ-দাদার পেশাকে পুজি করে জীবন সংগ্রামে টিকে আছেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এই পেশার সাথে জড়িত। তবে মাঝে মাঝে স্বামী অন্যের মৎস ঘেরে কাজ করে।
ললিতা মন্ডল আরো জানান, এক সময় মেলে মাদুরের প্রচুর চাহিদা ছিলো কিন্তু এখন চাহিদা কমে গেছে। তাছাড়া আগে মেলে ঘাস হতো তাদের এলাকাই কিন্তু সেটিও কমে গেছে নোনা জলের কারণে। যশোর-নড়াইল থেকে এই মেলে আনতে হয় ফলে মেলে-মাদুর তৈরিতেও খরচ হচ্ছে বেশি ফলে দাম বেশি হওয়ায় মানুষ কম দামে প্লাস্টিকের মাদুর ব্যবহার করছে। একটি মেলে মাদুর তৈরিতে মেলে ও পাটের দড়ি মিলে খচর হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। একটি মাদুর তৈরি করতে প্রায় এক থেকে দুদিন সময় লাগে। সপ্তাহে তিন থেকে চারটি মাদুর তৈরি করা সম্ভব হয়। এই মাদুরগুলো আবার বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। নামাজী মাদুর ১০০ টাকা, সাতপোয়া মাদুর ১৫০ টাকা, দু হাত মাদুর ২০০ টাকা, আড়াই হাত মাদুর ৩০০ টাকা, এগারো পোয়া মাদুর ৪০০ টাকা, নয় পোয়া মাদুর ২৫০ টাকার মত। এর মধ্যে শক্ত কাটিরগুলো একটু দাম বেশি।
ললিতার স্বামী বিধান মন্ডল জানান, এই মাদুরগুলো এলাকার বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন। তাছাড়া ব্যাপারীরাও এসে নিয়ে যান। তবে মাদুর বিক্রিতেও পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ছাপ। আগে আশাশুনি মেলে মাদুর তৈরিতে প্রসিদ্ধ ছিলো। কিন্তু গেলো এক-দেড় দশকে নোনার প্রভাবে এই এলাকায় তেমন মেলে হয়না ফলে মেলে মাদুর তৈরির কারিগর কমে গেছে। এর ফলে এই এলাকাতে মেলে মাদুর চাহিদা কমে গিয়ে বিক্রির হাটের পরিমাণও কমে গেছে।
বিধান মন্ডল আরো জানান, পাশ^বর্তী জেলা যশোর ও নড়াইল থেকে এই মেলে কিনে আনতে হয়। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে মেলে কিনতে। সেখান থেকে সারা বছর ধরে মাদুর তৈরি করেন তারা। কিন্তু আগে তাদরে এলাকার নদীর চরে এই মেলে হতো। কিন্তু এখন সেটা হয় না। তবে বর্ষা মৌসুমে তাদের পতিত ৩ কাঠা জায়গায় মেলে রোপণ করেন। তবে নদীর চরের মত এই মেলেগুলো ভালো মানের হয় না। ফলে বেশি খরচ হলেও ভালো মেলে দিয়ে তৈরি করেন মাদুর। আর এলাকায় পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ না থাকায় এই মেলেতেই তারা জীবনসংগ্রাম খুঁজে নিয়েছেন।
শুধু ললিতা মন্ডলরাই নয় আশাশুনির নাটানা গ্রামের দিপালী বৈদ্য, দীনেশ বৈদ্য, কাকলী মন্ডল ও পঞ্চলা মন্ডলরাও এই মেলে মাদুর দিয়ে কোনমতে জীবনযাপন করছেন। মেলে মাদুর দিয়ে অতিবাহিত করছেন জীবনসংগ্রাম।

happy wheels 2

Comments