পরান পুকুরে প্রাণের মেলবন্ধন

রাজশাহী থেকে মো: শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
পুকুরের নামেই একটি গ্রাম। পিরান পুকুর, কেউ বলে পরান পুকুর। রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা পৌরসভা থেকে ২ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম পিরান পুকুর। প্রবীণদের কাছে জানা যায়, পিরান বাবু বা পরান বুবু নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির বসবাস ছিলো এই এলাকায়। দেশ বিভাগের (ভারত-পাকিস্তান) অনেক আগেই এই পরিবারটি দেশান্তরিত হয়। তাঁর নিজস্ব পুকুর ছিলো এটি। তাই এই নামেই পুকুর এবং গ্রামের নামের সৃষ্টি।


বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই পানির সমস্যা ছিলো কম বেশি। আগেরকার দিনে রাজা বাদশারা প্রজাদের পানি প্রাপ্তির সুবিধার্থে বিশাল বিশাল পুকুর খনন করে দিতো। তখনকার দিনে রাজশা বাদশা বা জমিদারদের এটাই ছিলো অন্যরকম বড় কাজ। আর এসব পুকুরের পাড়ের চারিধারে গড়ে উঠতো জনপদ। এভাবেই পুকুরগুলোর ধার দিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে। কালের বিবর্তনে এই পুকুরগুলো ভরাট বা দখলের কারণে ছোট হয়েছে। বিশাল পুকুরগুলো হয়তো এখন আয়তনে ছোট হয়েছে বা ভরাট হয়েছে। তবে চলমান সময়ে পানির সমস্যা আরো প্রকট হবার কারণে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে পুকুর খনন এবং পুকুর সংস্কারের কাজগুলো অনেক উন্নত হয়েছে।


পুকুরকে ঘিরে প্রাণের বন্ধন

পিরান পুকুর গ্রামে এক সময় পুকুরের পাড়টিতে আদিবাসী মাহালীদের বসবাস ছিলো। পুকুরের জল শুকালে বা চৈত্র্য বৈশাখ মাসে পুকুওে জল না থাকলে দিনি দিনে মাহালী সম্প্রদায় এই পাড়া থেকে অন্য এলাকায় চল যায়। মূলত পুকুর পানি না থাকার কারণে তারা অন্যত্র চলে যায়। তবে এখনো মাহালী সম্প্রদায়ের দুটি পরিবার আছে। পুকুরসহ এর আশা পাশের জায়গাটি খাস হওয়ায় পুকুর পাড়ে আশপাশের গ্রাম থেকে বিভিন্ন ধর্মের লোকজন এসে বসবাস শুরু করেন। আদিবাসি, বাঙালি এবং সনাতন ধর্মের লোকজন নিয়ে এখন এই গ্রামটিতে ২৭টি পরিবারের বসবাস। সকল ধর্মের মানুষের একটি মেলবন্ধন তৈরি করেছে একটি পুকুর।


পুকরে একসময় পানি না থাকলেও এখন প্রায় বারো মাসেই পািিন রাখার ব্যবস্থা করেছেন গ্রামের সকল পরিবার মিলে। হালকা সংস্কার করে তাতে নিয়মিত পানি ভরাট করা হয়। বিগত প্রায় সাত বছর থেকে পুকুরটিকে ঘিরে গ্রামের মানুষের নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তৈরি হয়েছে প্রাণের মেলবন্ধন। পুকুরটিতে এখন বারো মাসে পানির ব্যববস্থা থাকায় সেখানে যৌথভাবে সবাই মিলে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মাছ চাষ করে বিক্রি না করলেও এখন গ্রামের মানুষের মাছের যোগান দিতে পারছে। নিজেরা পুকুরের মাছ খেতে পাচ্ছেন। গ্রামটির আবুল কালাম আজাদ (৪৫) বলেন, ‘এখনো বিক্রি করিনি, তবে নিজেরা মাছ মেরে ভাগ বটোয়ারা করে নিয়ে থাকি, এর ফলে আমাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।” গ্রামের এই পুকুরের পানি দিয়ে বাসন কোসন, কাপড় চোপড়সহ গবাদি পশুকে পানি খাওয়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।


আশে পাশে কোন পানি না থাকায় এই পুকুরের পানি দিয়ে গ্রামের ২৭টি পরিবার বাড়িতে সবজির চাষ করছেন। সেই সবজি তাদের পুষ্টি চাহিদা পুরণে সহায়তা করছে। পুকুরটির চারপাশে সবুজের সমারোহ। এখানে বাশঝার থাকায় নানা জাতের পাখির বাসা বেঁধেছে। গ্রামটির আঙ্গুরি বেগম (৩৫) বলেন, ‘আমি বাড়ির সব ধরনের সবজি এখনর এই পুকুরের পানি দিয়ে চাষ করে থাকি। আমরা সবজি চাষে কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করিনা। জৈব সার ব্যবহার করি।’


গ্রামটিতে বিভিন্ন বিষয়ে জনগোষ্ঠীর উদ্যোগগুলোতে সহায়তা করে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, সংগঠনটির কমিউনিটি ফেসিলিটেটর রিনা টুডু (২৫) বলেন, ‘আমরা গ্রামটির মানুষকে দেশি সবজি বীজ বিনিময় করতে সহায়তা করি এবং একই সাথে জৈবসার ব্যবহারে কৌশলগুলো শিখিয়ে দেই।” তিনি আরো বলেন, ‘একসাথে যৌথভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে নিয়মতি গ্রাম সভা করা হয়। এই সভার মধ্যেই গ্রামের সমস্যা সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরা হয়।’

উপসংহার
পুকুরকে ঘিরে একটি গ্রামের উন্নয়ন, সবাই মিলে পুকুরে মাছ চাষ এবং আমিষের চাহিদা পুরণে অন্যরকম অবদান রাখছে পুকুরটি। যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করায় পুকুরের পানি ব্যবস্থাপনায় কোন সংকটও নেই। একই সাথে পুকুরটির চার পাশ ঘিরে প্রাণবৈচিত্র্যের যে সমাহার তা চোখে দেখার মতো। একদিকে পাখির কলকাকলি, অন্যদিকে বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবুজের সমারোহ এবং গবাদি পশুপাখির বিচরণ পুকুর কেন্দ্রিক উন্নয়নের নমুনা। বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামভিত্তিক পুকুরগুলোর ব্যবস্থাপনা এভাবে গ্রামের মানুষের হাতে দিলে পানি ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন আরো বেগববান হবে। তাই পুকুর লিজ পদ্ধতিত পরিবর্তন আনা জরুরি।

happy wheels 2

Comments