আমাদের কেউ দেখে না!

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
আমাদের ইতিহাস বলে দেয় প্রাণের সাথে প্রকৃতির রয়েছে আন্তঃসম্পর্ক। প্রকৃতিই আমাদের বেঁচে থাকার রশদ যোগায় বা উৎস। আমরা জানি যে প্রকৃতি ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব কিন্তু আমরা প্রকৃতির প্রতি এত এত বিরূপ আচরণ করছি যে সে এখন আমাদের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।


ষড়ঋতুর দেশ ছিল আমাদের দেশ। মাসের হিসাবে আবহাওয়ার গতি বিধি মুখস্থ ছিল আমাদের কৃষকদের। মেঘের অবস্থান দেখে, কীটপতঙ্গের চলাফেরা, বাতাসের দিক অনুমান করে নিজেদের কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। আর সেই কারণে কৃষি ছিল আমাদের প্রধান পেশা এবং দেশ কৃষি প্রধান দেশ।


কিন্তু এখন প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আমাদের থেকে। আধুনিক সহজতর বিলাসবহুল জীবনযাপনে হারিয়ে ফেলেছি আমাদের ষড়ঋতুকে। এখন আর বাতাসে গতিবিধি কেউ বুঝেনা,সংকেত দেয়ার কীটপতঙ্গও হারিয়ে যাচ্ছে। এখন বৃষ্টি, খরা, ঝড় বাতাস, কুয়াশা পড়ার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই।


যার প্রভাব পড়েছে আমাদের গ্রামীণ কৃষির উপর। যার প্রভাব কৃষকদের বছরের পর বছর বয়ে বেড়াতে হয়। গত মে মাসে একাধারে ১৬ দিন বৃষ্টি থাকার কারণে কৃষকদের জীবিকায়নের একমাত্র অবলম্বন ধান ঘরে তুলতে পারেনি। কারণ তখন ছিল বোরো ধান কাটার মৌসুম। আমাদের নেত্রকোনা অঞ্চলের কৃষকরা বোরো মৌসুমে বেশির ভাগ সময়ই ব্রি-২৮ এবং ব্্ির-২৯ ধান চাষ করে। ব্রি-২৮ ধান যারা চাষ করেছেন তাদের ধান সংগ্রহে তেমন কোন সমস্যা হয়নি কিন্তু যে কৃষকরা ব্রি-২৯ ধান চাষ করেছে তারা পড়েছেন বিপাকে।


নেত্রকোনা জেলার বামনমোহা গ্রামের কৃষক শামচ্ছুদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আমি ২২ কাঠা জমিতে ব্রি-২৯ ধান চাষ করেছি। প্রায় ১৫০ মণ ধান তুলতে পারতাম কিন্তুু টানা ১৬ দিন বৃষ্টি থাকার কারণে মাত্র ৬০ মণ ধান ঘরে আনতে পেরেছি। বাকি ধান জমিতে পচেছে। ধান পোক্ত হওয়ার আগেই গুড়ি পচেঁ ধান পানিতে পড়ে গেছে, চিটা হয়েছে, নেক ব্লাষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া যেগুলো সংগ্রহ করেছিলাম সেগুলোও রোদ না থাকায় শুকাতে পারিনি। এখন ভাত রান্নার করার পর ২ ঘণ্টাও ভালো থাকে না ঘেমে উঠে, গন্ধ লাগে। অন্যবছর ধান কাটাতে কাঠাপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা লাগত কিন্তু এ বছর ১০০০ টাকাতেও কাটতে পারিনি। ২২ কাঠা জমি করতে সেখানে খরচ হয়েছে প্রায় ৪২০০০হাজার টাকা। খরচ উঠবে তো দূরের কথা ঘরের ভাত পর্যন্ত খেতে পারিনা।”
একই গ্রামের কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, “যাও কিছু তুলেছি কিন্তু ভাত খেতে পারিনা । আমার বাচ্চারা কান্ন্কাটি করে। ভাত তিতা লাগে। বিক্রি করাও যায় না। কোন মিলেও বিক্রি করতে পারিনাই।”


বামনমোহা চকপাড়া গ্রামের কৃষক ওয়াসিম মিয়া বলেন, ‘আমরা ৬ ভাই মিলে জমি লিজ নিয়ে প্রায় ১২০ কাঠা জমিতে ধান করেছি। কাঠা প্রতি ধান তুলতে পেরেছি ৩ থেকে ৪ মণ করে। তারপরও সম্পূর্ণ জমি কাটতে পারিনি। ধান কালো হয়ে গেছে, ধান শুকাতে দিলে মাংস পচার মতো গন্ধ বেরোয়। সার, সেচ, জমির লিজের টাকা দিতে পারিনি। আমাদের কেউ দেখে না। আমরা কার কাছে যাব। আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। ঘরে ভাত খেতে পারিনা আবার মাথার উপর ঋণের বোঝা। কাঠা প্রতি চাষ ৩০০ টাকা, সেচ ৫০০টাকা,সার ১২০০ টাকা করে প্রায় ২,৪০,০০০ টাকা খরচ হয়েছে জমি লিজের টাকা বাদ দিয়ে। এখন আমরা নিঃস্ব, অসহায়।”


মিনারা বেগম বলেন, ‘গরুর খাবারের বন/খড়টুকুও সংরক্ষণ করতে পারিনি। এখন বিলের কচুরিপানা, গাছের লতা পাতাই একমাত্র ভরসা। শাকসবজি না থাকলেও লতা পাতা কুড়িয়ে খাওয়া যায় যদি ভাত ভালো হয়।”
আজ প্রকৃতির সাথে দূরত্বের ভোক্ত ভোগী আমরা। দৈন্যতা আমাদের গ্রাস করছে। বৈচিত্র্যহীন প্রকৃতিই মানুষের বৈচিত্র্যহীন হয়ে উঠবার অন্যতম কারণ। বৈচিত্রহীন প্রকৃতির মানুষ কখনই বৈচিত্রময় হতে পারে না। দিনদিন মানুষ দরিদ্র,মূল্যবোধহীন, আত্মকেন্দ্রিক, অস্বচ্ছ ও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে নানা জটিলতা। ধেয়ে আসছে অবক্ষয়।
তবে কৃষকরা আবারও স্বপ্ন দেখছেন সোনালী ফসল ঘরের তোলার। তাই আমন মৌসুমে ধান রোপণ করছেন তারা। বাড়ীর আশপাশে সবজি বীজ বপন করেছেন। জমি প্রস্তুত করছে শীতের সবজি চাষের জন্য। ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের সৃষ্টি করে আমাদের কৃষকরা।

happy wheels 2

Comments