কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা

সিলভানুস লামিন

খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্য সার্বভৌমত্ব বহুল আলোচিত দু’টি শব্দ! বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট খাদ্যাব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকেই খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যারা, বিশেষ করে কৃষকরা মনে করেন তাদের খাদ্য সার্বভৌমত্ব হুমকির সন্মূখীন। অন্যদিকে কৃষকদের খাদ্য সার্বভৌমত্ব হুমকির সন্মূখীন হলে বিশ্বব্যাপী মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাও বিপন্ন হবে। কারণ কৃষকরা যদি স্বাধীনভাবে খাদ্য উৎপাদন করতে না পারেন, উৎপাদন উপকরণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা ব্যাহত হবে। খাদ্য সার্বভৌমত্বের বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয় ১৯৯৬ সালে। নিজেদের খাদ্য, কৃষি, পশুপালন ব্যবস্থা, মৎস্য চাষসহ খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে কৃষকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারই হচ্ছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব। অর্থ্যাৎ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় বাহ্যিক বা বহিরাগত চাপমুক্ত হয়ে কৃষক যখন নিজেই খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং তিনি কী উৎপাদন করবেন, কোথায় করবেন, কোন উপকরণ ব্যবহার করবেন, কৃষি উপকরণগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করবেন, কার কাছে উৎপাদিত খাদ্য বিক্রয় করবেন, কী পরিমাণ সংরক্ষণ করবেন ইত্যাদি বিষয়ে কৃষক যখন নিজেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা লাভ করেন তখন তাকে কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। অন্যকথায় বলা যায়, পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি না করেই উৎপাদিত এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাদ্যের ওপর কৃষকের অধিকারই হচ্ছে খাদ্য সার্বভৌমত্ব।
1---
খাদ্য সার্বভৌমত্বের আলোচনায় খাদ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে দেখা হয় যেখানে সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর, নিরাপদ ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত খাদ্যে সবার সমান অভিগম্যতা থাকবে; থাকবে সমমর্যাদা। এই আলোচনায় একটি বাস্তবসম্মত কৃষি সংস্কারের কথা উত্থাপিত হয়েছে যেখানে কৃষক বিশেষ নারী যেসব জমিতে চাষবাস করছেন সেসব জমিগুলোর ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য কৃষকরা যে খাদ্য উৎপাদন করবেন সেগুলো স্থায়িত্বশীলভাবে অর্থ্যাৎ পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সে বিষয়টির দিকেও আলোকপাত করা হয়। অন্যদিকে খাদ্য সার্বভৌমত্ব আলোচনায় খাদ্যকে পুষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়; বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে নয়। তাই খাদ্য এমনভাবে উৎপাদন করতে হবে যাতে সেটি মানুষের শক্তির ও পুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করে যেখানে খাদ্য হবে ক্ষুধার্তকে চিরতরে বিতাড়িত করার হাতিয়ার। সমাজে ও রাষ্ট্রে ক্ষুধার্ত বিতাড়িত হলে, পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষিত হলে এবং খাদ্য উৎপাদকগণ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা লাভে সমর্থ হলে একটি শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। খাদ্য সার্বভৌমত্ব আলোচনায় মূলত এই বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমরা কী দেখি? বাণিজ্যিক কৃষির আগ্রাসনে আজ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা কোণঠাসা। খাদ্য উৎপাদন করে তারা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতরণ তো দূরের কথা, তাদের নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তাই আজ বিঘ্নিত! খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং এ খাদ্যের ওপর আমজনতার অভিগম্যতাকে বুঝায়। কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষি মুনাফার জন্য রপ্তানিযোগ্য খাদ্য উৎপাদনের দিকেই বেশি জোর দিয়েছে; স্থানীয়ভাবে খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং খাদ্যে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকারকে এই আধুনিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আমলে নেয় না। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতা তৈরি করা; রপ্তানি বা বাণিজ্য করা নয়। কিন্তু আমরা কী দেখি? রপ্তানির জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশের বিষয়টি কর্পোরেট কৃষির কর্তাদের চিন্তায় কখনও মূখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থের পানি উত্তোলন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের ভূমি দখল, বন উজাড় এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভক্ষণকারী যান্ত্রিক কৃষি উপকরণের বহুল ব্যবহারই হচ্ছে আধুনিক তথা বাণিজ্যিক কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংস্কৃতিক খাদ্য উৎপাদন তো পরের বিষয় বরং বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য কৃষিমাঠে সেসব শস্য-ফসল আবাদ করা হয় যেগুলো দিয়ে ওইসব জীবাশ্ম জ্বালানি তৈরি করা যায়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য বিশ্বের অনেক কৃষিজমিতে বাণিজ্যিকভাবে Jatropha’ উৎপাদন বেড়ে গেছে। তাই তো দেখা গেছে, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বাণিজ্যিক পণ্যের দামের কারণে কৃষকরা একদিকে যেমন দিশেহারা হচ্ছেন অন্যদিকে এসব উপকরণ ব্যবহারের কারণে তাদের জমি ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হতে শুরু করেছে।

আধুনিক কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার আগ্রাসনে কৃষিজমির ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানাও আজ অনেকটা বিপন্ন। বিশ্বে প্রতিদিন অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক তাদের চাষবাসের জমি হারাচ্ছেন! কারণ কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং উৎপাদিত কৃষিজ ফসল বিক্রি করে লাভবান হতে না পারায় তারা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা শেষ সম্বলটুকু তথা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে কৃষি উপকরণের জন্য ঋণ নিতে গিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় আত্মহত্যা করতে পিছপা হন না। তাই তো দেখা গেছে, ভারতে ১৯৯৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছেন শুধুমাত্র কৃষিঋণ পরিশোধ করতে না পেরে! বাণিজ্যিক কৃষি স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারেও নিরব। বরং এই খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থায় আমরা যে খাদ্য খাই সেটি আসলে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে মিশ্রিত এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের খাদ্য তালিকায় ঐতিহ্যবাহী ধান বলতে গেলে উধাও হয়েগেছে! খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক ও অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব থেকে ক্ষুধাকে বিতাড়িত করা এবং আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল কারণটিও হচ্ছে ক্ষুধাকে বিতাড়ণ করা। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে! ফাও’র ২০০৩ সালের প্রতিবেদন মতে, চরম দরিদ্রতার কারণে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৮৫২ মিলিয়ন এবং নানা কারণেই বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। ওই প্রতিবেদন মতে, প্রতিবছর ৬ মিলিয়ন শিশু ক্ষুধার্তজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। ২০১৬ সালে এসে এ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই কমে যায়নি! হয়তেবা আরও বেড়ে গেছে!

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্টই বলতে পারি যে, আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্বের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আধুনিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও খাদ্যনিরপাত্তা নামক প্রত্যয়গুলোর কোন মূল্য নেই! ফলশ্রুতিতে বিশ্বে শান্তি ও উন্নয়ন বিঘ্নিত হচ্ছে; বেড়েছে সংঘাত ও সহিংসতা! কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হলে একদিকে যেমন বিশ্বের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত হতো বিধায় পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের হার হ্রাস পেতো, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমতো। কারণ কৃষক তার লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে যে খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা অনুশীলন করতো সেটি প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করে। বাইরের উপকরণ তথা রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহৃত হয় না বলে উৎপাদিত শস্য-ফসল ভেজালহীন; স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয় না।

আমরা জানি যে, কৃষিখাত এখনও বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত হিসেবে বিবেচিত; এখনও এই খাতে সবচে’ বেশি মানুষ জড়িত! বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে মূলত: কৃষকদের জন্যই। জাতীয় আয়ের প্রায় এক চতুর্থাংশ কৃষি থেকে আসছে। এটিই বড় কথা নয়, দেশের মোট ৬ কোটি ৩০ লক্ষ শ্রমজীবী জনসংখ্যার ৮১ শতাংশই গ্রামীণ শ্রমজীবী যাদের ৬৮.৫ শতাংশই কৃষির সাথে জড়িত (২০০৮ সালের তথ্যানুযায়ী)। এই সব মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির যে কোন ধরনের বিপর্যয়ে তাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই বিশাল জনগোষ্ঠী। কিন্তু আধুনিক কৃষির আর্বিভাব, বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে লাভবান হতে না পারায় কৃষিপেশার প্রতি কৃষকের আগ্রহ বলতে গেলে আজ শুন্যের কোঠায়! উপরোন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানান দুর্যোগের কারণে মাঠের ফলানো কৃষিজ শস্য-ফসল নষ্ট হওয়ার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিপেশা কৃষকের কাছে আর লাভজনক হচ্ছে না। তাই তো কৃষকের সন্তান এখন আর কৃষক হতে চায় না! শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত হলে তো কোন কথায় নেই! শিক্ষিত কৃষকের সন্তান বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার গুণে বাজারে প্রচলিত লাভজনক পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে প্রাণপন চেষ্টা করে। অন্যদিকে শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত না হলেও কৃষকের সন্তানেরা কৃষি ব্যতিত অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করে। অথচ একসময় কৃষকের সন্তানেরা ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রাখার চেষ্টা করতো, পূর্ব পুরুষের পেশা নিয়ে তারা গর্ব করতো!

কৃষির সেই সুদিন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাই কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে। কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে। কারণ কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হলে পুষ্টিকর ও ভেজালহীন খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ থাকবে সুরক্ষিত। আর কৃষকের খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হলে আমাদের সবার খাদ্য নিরাপত্তাও যে নিশ্চিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

happy wheels 2