তাঁর মত সুখী গ্রামে কেউ নেই : পরিশ্রমী আকলিমার জীবনের গল্প

সাতক্ষীরা থেকে বরুণ ব্যানার্জী

প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে কুরআন তেলাওয়াত, তারপর বৃদ্ধ মায়ের কাজের সহযোগিতা। ঘরের থালা-বাসন ধুয়ে জনসমস্যা নিয়ে আসা মানুষের সাথে কথা বলা। এরপর নিজ মটর সাইকেল নিয়েই বাইরে বের হয়ে এলাকার মানুষের কৃষি বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া। সপ্তাহে চারদিন এলাকার নারীদের প্রশিক্ষণ। তাছাড়া ইউপি সদস্য হিসেবে রেজিষ্ট্রার মেইনটেনও করতে হয়। মানুষের সুবিধা-অসুবিধাও দেখতে হয় তাকে। এভাবে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পরিচিত মুখ আকলিমা খাতুন এভাবেই তার দৈনন্দিন কার্মকান্ডের কথা বর্ণনা করেন।

অল্প বয়সে এমন কঠোর কাজগুলো কিভাবে করছেন জানতে চাইলে আকলিমা বলেন, ‘প্রকৃতি তাকে প্ররিশ্রমী হতে বাধ্য করেছে। এক সময়ে চাকুরী আশায় ঘুরে টাকার কাছে হেরে গেছি। অবশেষে বেছে নেই এই কঠিন পথ। যে কঠিন পথ এখন জীবনটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।’

তাই বলে তিনি কি অক্ষরজ্ঞানহীন একজন গ্রামের মেয়ে আকলিমা নন! রয়েছে তাঁর উচ্চ শিক্ষাও। ইতিহাস বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রীধারী, রয়েছে শিক্ষক নিবন্ধন সনদপত্রও। এতোকিছুর পরও মাটির দেয়াল আর টালী দিয়ে তৈরি ছোট্ট কুড়েঘরই আকলিমা ও তার মা সুফিয়া খাতুনের শেষ ঠিকানা। তবে তিনি নিজেকে একজন সুখী ও অভাবহীন নারী বলেই অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার মত সুখী এই গ্রামে কেউ আছে বলে আমার জানা নেই।’
pic-1
ঘরের থালা-বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে মাঠের কৃষি কাজ। এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধানেও অগ্রগামী। কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে এমন কি নেই যে আকলিমাকে না করতে হয়? নারী বলে যাতায়াতের জন্য অন্যজনের অপেক্ষা? না। নিজেই মটর স্কুটি চালিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর কাজটিও করতে হয় নিজেকেই। সংসার জীবন থেকে শুরু করে কৃষি কাজ আবার জনপ্রতিনিধিত্বের কাজটি করছেন দূরন্ত গতিতে। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আকলিমা খাতুনকে তার পরিশ্রমই তাকে পরিচিত করে তুলেছে। স্থানীয়ভাবে সংবর্ধনা পেয়েছেন কয়েকবার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার। স্থানীয় ইউনিয়নের সংরিক্ষত ওয়ার্ডের মেম্বরও এই আকলিমা। একজন নারী হয়ে যেটি অর্জন করেছেন তা অনেক পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয় মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।

কর্মময় নারী আকলিমা খাতুন তার জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে আরও বলেন, ‘চার বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আমি। অপর তিন বোন বিবাহিত।’ ১৯৭৯ সালে জন্ম নেওয়া আকলিমা স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ১৯৯১ সালে চলে যান পার্শ্ববর্তী যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাশের পর ভর্তি হন রাজগঞ্জ কলেজে। ওই কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাশ করে মনিরামপুর কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হন। পরের বছর খুলনা সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তির সুযোগ পান। মনিরামপুর কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন বিএল কলেজে। বিএল কলেজে পড়া অবস্থায় ২০০০ সালে এলাকায় বন্যা হয়। খবর পেয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখেন এলাকার মানুষের কষ্টের যেন শেষ নেই! আকলিমার বৃদ্ধ পিতা সামসুদ্দিন সরদার ছিলেন কৃষক। নিজেদের পৌনে পাঁচ বিঘা জমি চাষ করেই তাদের সংসার চলত। কিন্তু ওই জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। কপোতাক্ষের সংযোগ বাওড়ে কোন বাঁধ না থাকায় জমি যেন বাওড়ের সাথে মিশে যায়। তাদের মত অবস্থা এলাকার অন্য সবারও। উপায় না পেয়ে তারা সবাই যেন ত্রাণনির্ভর হয়ে পড়ে। ত্রাণ আছেতো খাবার আছে, ত্রাণ নেইতো খাবারের কোন যোগাড় নেই। তার পিতাও ত্রাণ নিয়ে সংসার চালান। মাঝে মধ্যে আকলিমাও অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন।

মাঝে-মধ্যে এলাকায় জোন দিতে যেতে হয় তাকে। একদিন তার পিতা জোন দিয়ে এসে বারান্দায় শুয়ে পড়েন। দেখে তার কষ্ট লাগে। আর দেরি না করে খুলনা ফিরে কলেজ থেকে বই-খাতা, নোট সব নিয়ে বাড়িতে যান আকলিমা। চেষ্টা করেন স্থানীয় স্কুলে চাকরি করার। কিন্তু একজন প্রভাবশালী নেতা চাকরির জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। এত টাকা যোগাড় করার উপায় ছিল না তার। চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে যোগাযোগ করেন কৃষি অফিসে। যে জমি আছে তাতেই কোন ফসল উৎপাদন করা যায় কি না এমন পরামর্শ নেন। গ্রহণ করেন সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে নিজেই উক্ত বাওড় সংলগ্ন দুই বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলক ধান রোপণ করেন। জমির চাষ থেকে শুরু করে বীজ বপন, সার বোনা সব কাজই করেন নিজে। তাকে সহযোগিতা করেন তার পিতা। তার এ কার্যক্রম দেখে এলাকার অন্য কৃষকরা বিভিন্ন মন্তব্য করেন। কিন্তু প্রথম বছরই দু’বিঘা জমিতে ৩৮ মণ ধান পান আকলিমা। এরপরই এলাকার অন্যান্য কৃষিজীবী মানুষ উদ্বুদ্ধ হন। যারা তার কর্মকান্ড দেখে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন তাদেরই কেউ কেউ তার কাছেই পরামর্শ নেন। তার পরামর্শে অন্য কৃষকরাও ধান উৎপাদন শুরু করেন তাদের জমিতে। তারাও সফল হন।

স্থানীয় নারী কৃষকদের সংগঠিত করে আকলিমা গড়ে তোলেন আইসিএম মহিলা দল। দলের সদস্যদের কাছ থেকে মাসে একশ’ টাকা করে উঠিয়ে তা থেকেই তাদের মধ্যে ঋণ দেয়া হয়। আইপিএম ক্লাবও গড়ে তোলেন তিনি। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন আকলিমা। বাড়ির কাজের পাশাপাশি পড়াশুনায়ও পিছিয়ে নেই তিনি। পরীক্ষার আগের দিন রাজগঞ্জ গিয়ে থাকেন এবং সেখান থেকে পরদিন সকালে খুলনা গিয়ে পরীক্ষা দেন। এভাবে অনার্স ও মাষ্টার্স সম্পন্ন করে আকলিমা একজন উচ্চ শিক্ষিত নারী কৃষক হিসেবে এলাকায় পরিচিত হতে থাকেন। ২০০৩ সালে তার পিতার মৃত্যু হলে তার ওপরই এসে বর্তায় সংসারের ভার।

বিষমুক্ত কৃষি উৎপাদনে আকলিমার কিছু পদক্ষেপ বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, পার্চিং, লগো, হাজল, জৈব সার তৈরিসহ বিভিন্ন পদ্ধতির কথা। যেসব পদ্ধতি তিনি যেমন গ্রহণ করেন তেমনি অন্য কৃষকদেরও গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। কীটনাশক আর ফরমালিনের এই যুগে এবিসিডি অর্থাৎ (এ) এ্যাজমা, (বি) ব্লাড প্রেসার, (সি) কিডনি ও (ডি) ডায়াবেটিস রোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এভাবে পরিকল্পিত কৃষি বিপ্লবের বিকল্প নেই।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান জানান, একজন মেয়ে হয়ে আকলিমা যে কাজগুলো করে চলেছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। একই সাথে দেয়াড়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করে চলেছেন।এই প্রসঙ্গে কলারোয়া উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মহসীন আলী বলেন, ‘আকলিমা শুধু কৃষি বিপ্লবই ঘটাননি বরং পাকুরিয়া গ্রাম সংলগ্ন বাওড় তীরবর্তী ৬০ বিঘা পতিত জমি উদ্ধারেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে আকলিমার অবদান একদিন ইতিহাস হবে। তার মত সবাই চিন্তা করলে বাড়ির আঙিনার এক টুকরো জমিও পতিত থাকবে না।’

উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর। আর কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৫৪ হাজার। এর মধ্যে আকলিমা উপজেলার একজন মডেল হিসেবে পরিচিত। আকলিমার বৃদ্ধ মা সুফিয়া খাতুন স্বাবলীল ভাষায় বলেন, ‘স্বামী নেই, ছেলে নেই তাতে কি, আমার আকলিই সব। ওতো সব পারে। এলাকাবাসী বলেন, একটি মেয়ে হয়ে আকলিমা যা করেছে তা অনেক পুরুষের পক্ষেও সম্ভব নয়।’

 

ছবি: সংগৃহীত।

happy wheels 2