বিক্কা (ভিক্ষা) কইরা খাওনের মইদ্যে কোন সন্মান নাই

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা

“বিক্কা (ভিক্ষা) কইরা আর কয়দিন খাইতাম? মাইনসের কাসে হাত পাততে আর বালা লাগে না, হের লাইগা বহুত কষ্ট কইরা একখান গাড়ি বানাইয়া লইসি।” অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য এভাবেই নিজের সংগ্রামের কথা জানান প্রতিবন্ধী সিরাজ মিয়া। মুক্তিযুদ্ধের আগেই এক দুর্ঘটনা দু’টি পা হারিয়েছেন তিনি। তবে প্রতিবন্ধীত্ব বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মতোই নিত্যদিন সংগ্রাম করে জীবন সংসারকে টিকিয়ে রেখেছেন। পা হারানোর পর থেকে তিনি দীর্ঘ ৩০টি বছর ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন। তবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ও বোঝা হয়ে থাকার এই বেঁচে থাকাটি কোনভাবেই তাকে সুখ এনে দিতে পারেনি। তিনি জীবনের পরতে পরতে তার প্রতি মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, করুণা দেখে আসছেন। নিরবে-নিভৃতে অনেক অশ্রুজল বির্সজন দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে এই বেঁচে থাকাকে তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই ঠিক করেছেন তিনি তিনি উদ্যোগী হবেন; নিজেই নিজের অন্নের সংস্থান করবেন।

   kolma
ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় মানুষের ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অপমানের পাশাপাশি কিছু মানুষের সাথেও তাঁর দেখা হয় যারা তাকে এই অভিশপ্ত পেশা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিতেন। এভাবেই একদিন নেত্রকোণার দক্ষিণে বালিহুইস্কা গ্রামে এক নারীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ওই নারী সিরাজ মিয়াকে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরামর্শের পাশাপাশি তিনি সিরাজ মিয়াকে আর্থিক সহায়তা দেন যাতে এই অর্থ দিয়ে সিরাজ মিয়া নিজের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। ওই নারীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে সিরাজ মিয়া ২০ হাজার টাকা পান। নিজের জমানো কিছু টাকা মিলিয়ে তিনি একটি অটোরিক্সা তৈরি করেন। সেই অটোরিক্সাই এখন তার দুর্দিনের সাথী। প্রতিদিন তিনি এই অক্টোরিক্সা ভাড়া চালান এবং যা আয় হয় তা দিয়ে তিনি তার সংসারের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। যেদিন ভালো ভাড়া পান সেদিন পরিবারে ভালো খাবার জুটে আর যেদিন ভাড়া পান না সেদিন কষ্ট করে দিন কাটাতে হয় বলে তিনি জানান।

বর্তমানে যে অটোরিক্সাটি চালাচ্ছেন সেটা খুবই নড়বড়ে ও দেখতে সুন্দর না। তাই অনেক যাত্রী উঠতে  চায় না। যার কারণে অনেক ভাড়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। সাহায্যের জন্য হাত পেতেছেন বিভিন্ন জনের কাছে কেউ তাকে হুইল চেয়ার দেওয়ার কথা বলেন। হুইল চেয়ার দেওয়ার কথা শুনে বলেন, “হুইল চিয়ার দিলে আমার কিতা ওইবো হুইল চিয়ার দিলেতো বিক্কাই মাগন লাগবো”। তিনি চাচ্ছিলেন বর্তমানে যে অটোরিক্সাটি চালান তার চেয়ে একটু ভালো অটোরিক্সা কিনতে। অটো রিক্সা চালাতে গিয়ে অনেক সময় অনেক সমস্যায় পড়েন। একটি ভালো অটোরিক্সা পেলে এসব সমস্যা থাকবে না বলে তিনি জানান।

kolma-1
১১ বছর আগে আশপাশের গ্রাম লক্ষ্মীপুর, বাদুরকান্দা, গজারমারী, বরদল, ভেলুয়াতলী ও গৌরিপুরে থাকা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্য ৫০ জন। সদস্য সবাই প্রতিবন্ধী। তারা প্রতি সপ্তাহে মিটিং করে ১০ টাকা সঞ্চয় করেন। বর্তমানে তাদের সঞ্চিত টাকার পরিমাণ ৩০ হাজার টাকা। এই টাকা তারা নিজেদের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণের লেনদেন করেন। সংঠনটি উপজেলা সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধন করা হয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তারা ১৪টি চেয়ার সংগঠনের নামে অনুদান পেয়েছেন। এছাড়াও তারা সংঠনটি শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন কিন্তু কোন খান থেকেও কোন সাহায্য পান নি।  এ সংগঠনের মাধ্যমে সিরাজ মিয়া স্বপ্ন দেখেন একদিন না একদিন তার সংগঠনের কোন প্রতিবন্ধী পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। তারা নিজের মতো করেই এগিয়ে যাবেন এবং জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারবেন।

ভিক্ষাবৃত্তি পেশা সবসময়ই সিরাজ মিয়াকে কষ্ট দিতো। এই পেশায় থাকলে মানুষের আত্মসম্মান বলতে আর কিছুই থাকে না। ভিক্ষা চাওয়ার সময় নানান তীর্যক বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হয়; তারপরও সব কিছু সহ্য করে মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। তাই তো এ অসম্মান ও অপমান সহ্য করতে না পেরে সিরাজ মিয়াকে অটোরিক্সা চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়েছে। দু’টি পা না থাকায় তার জন্য এ পেশাটি ঝুঁকিপূর্ণ! তবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তিনি কোন বিকল্প পেশা ঠিক না করা পর্যন্ত পেশায় থাকবেন কোনভাবেই পুনরায় ভিক্ষাবৃত্তি পেশাকে বরণ করে নেবেন না বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, “বিক্কা কইরা খাওনের মইদ্যে কোন সন্মান নাই। হের লাইগা ওহন অটোরিক্সা চালাই”। বর্তমানে যে কাজটি করছেন তাতে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারছেন। সেই সাথে সমাজে একটা জায়গা করে নিতে পেরেছেন। পরনির্ভশীলতা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আয় রোজগার করে সংসার চালাচ্ছেন আর দশজন সাধারণ মানুষের মত।

৬১ বছর বয়সী সিরাজ মিয়া থাকেন কলমাকান্দা উপজেলার ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বরদল গ্রামে। তার পরিবারে তিনিসহ সদস্য সংখ্যা ৬ জন। সিরাজ মিয়ার দু’টি পা হারানোর বিষয়টি খুবই করুণ। একদিন তার পায়ে মধ্যে লোহা বিঁধে। ভালো চিকিৎসা না করাতে ইনফেশন হয়ে পায়ে পচন ধরা শুরু হয়। তারপর পচনের মাত্রা এমন পর্যায়ে চলে আসে যে, শেষে বাধ্য হয়ে দু’টি পা কেটে ফেলতে হয়। দুই পা হারানোর পর কোন আয় রোজগার করতে পারেননি তিনি।

একজন মানুষ যার দু’টি পা নেই! তারপরও তিনি সুস্থ সবল মানুষের মত স্বাধীনভাবে বাঁচতে চান। নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে সমাজের মাঝে নিজের জন্য একটা স্থান করে নিতে চান। সিরাজ মিয়াও এমন ধরনেরই মানুষ যিনি অসাধ্য সাধন করার স্বপ্ন দেখেন। তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছই পরাজিত হয়। সিরাজ মিয়া দেখে মার্টিন লুথার কিং এর সেই অমর কথাটি মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, “যদি উড়তে না পারো তবে দৌড়াও, যদি দৌড়াতে না পারো তবে হাট, যদি হাটতে না পারো তবে হামাগুড়ি দাও, যাই করো না কেন সামনে এগিয়ে যেতে হবেই”।

happy wheels 2