শিক্ষার সাথে বিনোদনের একটি যোগসূত্র রয়েছে

শিক্ষার সাথে বিনোদনের একটি যোগসূত্র রয়েছে

তানোর রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহীদ

সমাসপুর। একটি আদিবাসীদের পাড়া। রাজশাহীর তানোর থেকে এই পাড়ার দূরত্ব প্রায় ৬ কি. মি.। এই পাড়ার ১৩টি সাঁওতাল পরিবার বাস করে, যারা প্রায় সবাই দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দারিদ্র্যতা যেখানে বিরাজ করে সেখানে শিক্ষা কখনও অগ্রাধিকার হয় না। সাঁওতালদের বেলায়ও তাই হয়েছে। তাদের সন্তানেরা শিক্ষাবিমূখ। অভিভাবকরাও চান সন্তানেরা আয়বর্ধক কাজেই নিয়োজিত হোক। শিক্ষার আলো থেকে দুরে থাকার কারণে শিক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধি করা তাদের জন্য কঠিনই বৈকি। শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও এই সমাসপুর পাড়ার সাঁওতালদের জন্য বোধহয় এটি প্রযোজ্য নয়। তাই তো শিক্ষার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। নিজের ভাষায় পড়া তো দুরে থাক; বরং তাদের মধ্যে যারা পড়ালেখা করে তারাও বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তি, বিনোদনসহ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে স্কুলে প্রতিদিনের পড়া তৈরি করতে না পেরে অনেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে; অনেকেই প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়ে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়েছে! শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বলে সঙ্গত কারণেই অন্য বাসিন্দাদের সাথে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব অনেক বেশি। ১৩টি পরিবারের মধ্যে অবশ্য দিলীপ সরেনের অবস্থা একটু ভালো। দিলীপ সরেনের একটি মটর সাইকেলের গ্যারেজ আছে। গ্যারেজের আয় দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছে তার সংসার। সংসার ভালো চলায় তিনি তাঁর স্ত্রীকে পড়ালেখা করিয়েছেন। তার স্ত্রীর নাম আসন্তা মার্ড্ডি। তিনি স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছেন এবার।

এডু
এই আসন্তা মার্ড্ডিই সমাসপুর পাড়ার সাঁওতালকে স্বপ্ন দেখতে সাহস দিয়েছেন। তিনি নিজের সংসার, লেখাপড়ার পাশাপশি স্বেচ্ছায় পাড়ার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা ও উৎসাহিত করছেন তাঁর স্বামী দীলিপ সরেন। এই প্রসঙ্গে আসন্তা বলেন, “আদিবাসী বাচ্চারা প্রাথমিকভাবে বাংলা ভাষা বুঝতে পারেন না। তাই তাদের অক্ষর জ্ঞান প্রদানের সময় বাংলার পাশাপাশি মাতৃভাষাও ব্যবহার করতে হয়।” পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেন। এজন্য তিনি নিজস্ব সংস্কৃতির নাচ, গান ও কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রেখেছেন। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের ভাষার গান ও নাচ চর্চা করে। এতে করে তারা বিনোদন পায়। আসন্তা মার্ড্ডি মনে করেন শিক্ষার সাথে বিনোদনের একটি যোগসূত্র রয়েছে। শিক্ষার মধ্যে কোন আনন্দ না থাকলে কোন শিক্ষার্থীই সেই শিক্ষাকে উপভোগ করতে পারেন না। আদিবাসীরা নিজের ভাষায় পড়তে না পারা কিংবা শিক্ষকদের দেওয়া অনুশীলনগুলো করতে না পারায় আতংক নিয়েই স্কুলে যায়। ফলশ্রুতিতে তাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন বিনোদন নেই; আছে অস্বস্তি ও আতংক। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘লেখাপড়া শেষে যখন আমি বাচ্চাদের নাচ গান শেখানো শুরু করি তখন পাড়ার সকল নারীরা তাদের হাতের কাজ রেখে তা দেখার জন্য চলে আসেন। বাচ্চারা তখন আরও আনন্দ অনুভব করে।’ ছেলেমেযেদের ইচ্ছা তারা এসব শিখে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে, এমনটি জানালেন অংশগ্রহণকারী ইলিশা মুর্মু।

এডু-১
শিশু ও বালক-বালিকা যাতে শিক্ষায় মনোযোগী হন এবং তাদের অভিভাবকরাও যাতে সন্তানদের পড়াশোনায় গুরুত্ব দেন সেজন্য আসন্তা মার্ড্ডি চেষ্টা করেছেন অভিভাবকদের (মায়েদের) হাতের কাজ শেখানোর! তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন কাজের অবসরে মায়েদের সেলাইয়ের কাজে সংযুক্ত করার। এ বিষয়ে বলেন, ‘পাশের চাপড়া ও কালনা গ্রামের নারীরা সেলাইয়ের কাজ করছেন, রাজশাহী শহর থেকে কাপড় দিয়ে যায় সেলাইয়ের জন্য। সেলাই হয়ে গেলে মজুরি দিয়ে কাপড় নিয়ে যায়, যা নারীদের জন্য বাড়তি রোজগার।” এ কাজ শিখলে মায়েদের বাড়তি আয় করতে পারবেন। এতে করে তারা এই বাড়তি আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া ও পোশাকের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারবেন।
আসন্তা মাডির্ড ও দিলীপ সরেনের এই উদ্যোগ খুব ক্ষুদ্র হলেও এটি অবহেলিত ও শিক্ষায় বঞ্চিত দরিদ্র সাঁওতালদেরকে স্বপ্ন দেখতে সাহস দিয়েছে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে তাদের সন্তানেরা মানুষ হবে, দেশ ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে তারা মনে করেন। এছাড়া দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করবে এই শিক্ষা।

happy wheels 2