নিরক্ষরতা দুরীকরণে তারুণ্য: আমার পেরেছি-পারবো- এগিয়ে যাবো

রাজশাহী থেকে অমৃত কুমার সরকার, শহিদুল ইসলাম শহিদ, শহিদুল ইসলাম, ইসমত জেরিন, জাহিদ আলী

ছোট ছোট উদ্যোগই একসময় মানুষকে পৌছে দেয় কাঙ্খিত লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে শিক্ষা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সমাজের সকল মানুষের শিক্ষার সুযোগ আজও তৈরি হয়নি। কিন্তু শিক্ষা ছাড়া এ জাতির প্রকৃত উন্নয়ন আর অগ্রগতি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই এই ভাবনা থেকে গ্রামের সাধারণ প্রান্তিক মানুষকে শিক্ষার আলো দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহর গ্রামের স্বাপ্নিক তরুণ সবজুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন ও উত্তম সূত্রধরসহ অসংখ্য তরুণরা। তারা বলেন, “আমরা স্বপ্নের গ্রাম গড়তে, দেশ গড়তে নিজেদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই আমরা এই কাজের উদ্যোগগুলো গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করে যাচ্ছি। আর এই অব্যাহত কাজের মাধ্যমে আমরা আমাদের গ্রামের সকলকে নিরক্ষরমুক্ত করতে পেরেছি।” তারা আরো বলেন, “কোন কর্মসূচি বা প্রজেক্টে এর অপেক্ষায় আমরা থাকিনি। এক্ষেত্রে বারসিক আমাদের সাহস আর শক্তি সমন্বয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আমার পেরেছি, আমরা পারবো, আমরা এগিয়ে যাবো।”
img_20160907_160959
শিক্ষার জন্যে প্রয়োজন হলে সুদূর চীন দেশে যাও। চীন দেশে যাবার প্রয়োজন না হলেও রাজশাহীর মোহর গ্রামের এই তরুণরা অভূতপূর্ব কাজ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মূলত ২০১৪ সালের মোহর গ্রামের যুবকগণ স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সের মানুষ সমন্বিতভাবে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপন করেন। সেদিন তরুণরা শুধু দিবস কেন্দ্রিক আলোচনা আর র‌্যালি উদযাপনের মধ্যেই ছিলেন না। সেদিন তাঁরা নিজের গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার এক স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা পরিকল্পনা নেন নিজেদের প্রচেষ্টায় তাদের গ্রামকে নিরক্ষর মুক্ত করবেন।
যেই কথা সেই কাজ। তারা প্রথমে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে নিরক্ষর ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু এই কাজে গিয়ে তাঁদের বাঁধার সম্মুখিন হতে হয়। কারণ অধিকাংশ নিরক্ষর ব্যক্তিই বয়স্ক বলে তাঁরা লজ্জায় প্রথমে তাদের নিরক্ষরতার বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি। কিন্তু থেমে থাকেননি তরুণরা। তারা বিভিন্ন সরকারি অফিস, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে খুঁজে বের করেন কারা টিপসহ দিয়ে থাকেন। তারা ধীরে ধীরে এসকল নারী-পুরুষদের সাথে মিশতে থাকেন এবং অবশেষে বুঝাতে সক্ষম হন যে নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। আর টিপ দেয়াটাই লজ্জাজনক। নানানভাবে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তারা বয়স্ক নারী-পুরুষদের সাক্ষরতা শেখানো শুরু করেন।
img_20160907_161826
অন্যদিকে তাদের অনেকের পেশা ও কাজের জন্য বিকেলবেলা, রাতে ও বিভিন্ন সময়ে তারা তাদের এই সাক্ষরতা অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন। জীবন ও পরিবেশ নিয়ে বাস্তবধর্মী যোগ বিয়োগের বিষয়গুলো স্থান পায় তরুণদের শিক্ষা কার্যক্রমে, যা কোন পাঠ্য পুস্তকে নেই। নিজের প্রকৃতি আর আশপাশের দৃশ্যমানতা আর অদৃশ্যমানতার যোগ বিয়োগের হিসেবে তারা শিখে। এ যেন জীবনের পাঠশালা হয়ে ওঠে। কোথা গেলে কোন সেবা পাওয়া, কোথায় কোন অধিকার পাওয়া যাবে, সবই স্থান পায় এই শিক্ষার সাথে।

শিক্ষা চলাকালীন এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীগণ অনুভব করেন বই পড়তে হবে, বইয়ের যোগ বিয়োগ শিখতে হবে। তরুণরা যোগাযোগ করলেন সে সময়ের তানোর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভুঞা এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সাথে। তরুণরা তাদের উদ্যোগ এবং সমস্যার কথা ইউএনওকে জানান। ইউএনও তাদেরকে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কাছে আবেদন করতে বলেন আর নিজেই আবেদনপত্র তৈরি করতে সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসক সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের প্রয়োজনীয় বই সহায়তা করতে আদেশ করেন জেলা উপ আনুষ্ঠানিক পরিচালককে। উপ আনুষ্ঠানকি পরিচালক নিজ উদ্যোগে সেদিন গোডাউন থেকে তরুণদের প্রয়োজনীয় বই তুলে দেন তরুণদের হাতে। তরুণরা বই হাতে ছুটে যান গ্রামে। শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়ে আরো আগ্রহ ও উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।
li
তরুণরা মোহরের বাঘা পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, পশ্চিম পাড়া, মিশন পাড়া মিলে মোট ৪টি পাড়াকে নিরক্ষরমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। অবশেষে গত ৭ সেপ্টেম্বর এক আনন্দঘন পরিবেশে তানোর উপজেলার শিক্ষা অফিসার বদিউজ্জামান পাড়া চারটিকে নিরক্ষরমুক্ত পাড়া ঘোষণা করেন। একই সাথে মোহর স্বপ্ন আশার আলো তরুণদের কাজে উদ্দীপ্ত হয়ে তানোরে গোকুল-মথুরার তরুণরা তাদের গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেন।

তরুণরা বলেন,“ আমারা আমাদের নিজের গ্রামের চারটি পাড়াকে নিরক্ষরমুক্ত করতে পেরেছি। আমরা বিশ্বাস করি অসাধ্য বলে কোন কিছু নেই। আমরা শুধু বয়স্কদের নিরক্ষরমুক্তই করিনি, পাশাপাশি এই গ্রামের ঝরে পড়া স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে সহায়তা করেছি। আমাদের পাড়ায় এখন এমন কোন ব্যক্তি নেই যে টিপ সই দিয়ে কোন কিছু করবে।”

happy wheels 2