ইচ্ছাশক্তির গুণেই অভাবী সংসার থেকে ‘অভাব’কে বিদায় করেছেন সেরিনা বেগম

নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনিতা রাণী ও রঞ্জু আকন্দ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার কবসা ইউনিয়নের খড়িবোনা গ্রামের মোসা. সেরিনা বেগম (৩৮)। স্বামী মোঃ দুলু মিয়া (৪৮)। বসত ভিটা বাদে কোন ফসলী জমি নেই। দিনমজুর স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না। সংসারে সব সময় অভাব অনটন লেগেই থাকে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে থাকেন সেরিনা বেগম। একসময় তিনি জড়িয়ে পড়েন নকশীকাঁথা ছাপানোর কাজ এবং কাথা সেলাই কাজে। তাঁর স্বামীর আয় এবং নকশীকাঁথা ও সেলাই কাজে সেরিনা বেগম যা আয় করেন তা দিয়েই বর্তমানে ভালোই চলছে তাদের সংসার।
14384207_641720689340054_1106990628_n
বাণিজ্যিকভাবে কাঁথায় ব্লক (কাঠের উপর খোদাই করা নকশা দিয়ে কাঁথা ছাপিয়ে) কবরে সেরিনা বেগম তার সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে করে চলেছেন নীরলস প্ররিশ্রম। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, , “আট বছর ধরে এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছি। এই কাজ শিখেছে আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। আমার মা কাঁথায় বিভিন্ন ধরনের নকশি ফুল তুলে মেশিনে সেলাই করতেন। আর আমি বসে বসে দেখতাম।” তিনি আরও বলেন, “আমি দেখেছি আমার মা কিভাবে এই কাজ করে সংসারে বাবাকে সাহায্য করতেন। মূলত দেখতে দেখতেই আমি নিজেও শিখে নিই কাজটি। আমার ছোট বোন সেলাইয়ের কাজ করতো আর আমি সেলাই মেশিন একটু একটু করে চালাতে লাগলাম।”

বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এলে সেরিনা বেগম অভাব ও অনটনের সাথে পরিচিত হন। তাই মায়ের কাছ থেকে শিখে নেওয়া কৌশল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাথাঁয় বিভিন্ন রকমের ফুল ছাপানোর জন্য তিনি তাঁর মায়ের সাথে যোগাযোগ করেন। এরপর তাঁর মা কয়েকটি কাঠের উপর খোদাই করা নকশা (ফুলের কাঠ) তাকে পাঠান। এরপর তিনি শুরু করেন খোদাই করার কাজ। ৮ থেকে ১২ ফিট একটি কাঁথা ছাপাতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। এভাবেই চলতে থাকে তাঁর কাজ। একসময় তিনি অভিজ্ঞ হয়ে যান এবং তাঁর মজুরি বাড়তে শুরু করে। তিনি একটি কার্পেট নকশা খোদাই করার জন্য মজুরি পান ১০০ টাকা, সুজনি ৩০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য কাপড়েও তার মজুরির তারতম্য ঘটে।
14408893_641720779340045_245478180_n-1
সেরিনা বেগমের কাছে প্রায় ১৬ প্রকারের কাঠের উপর খোদাই করা নকশার ফুল রয়েছে। এসব নকশার ফুলগুলোর মধ্যে রয়েছে সেজা, সুজনি, সোদনা, মোবাইল ফুল, লাভ ফুল, বেড়জমিন ফুল, গাছ ফুল, পান ফুল, কার্পেট, শাপলা ফুল, গোলাপ ফুল। এই সব ফুল কাঠের উপর খোদাই করতে ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয় বলে তিনি জানান। তিনি এগুলো পাশের গোমস্তাপুর বাজার থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেরিনা বেগম কাঁথা ছাপানোর পাশপাশি মেশিনেও সেলাই করে করেন। একটি কাঁথা সেলাই করে তিনি পান ৪৭০/৫০০ মজুরি নেন। এভাবে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ টি কাঁথা সেলাই করেন তিনি। বর্তমানে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি কাঁথা ছাপানোর অর্ডার পেয়েছেন সেরিনা বেগম। সংসারের কাজের পাশাপাশি এসব কাজ করেন তিনি। এসব কাজ করে তিনি যা আয় করেন তা সংসারের কাজে ব্যয় করেন বলে তিনি জানান। বছরে তিনি প্রায় ২৫ হাজার টাকা আয় করেন এসব কাজ করে।
14408795_641720876006702_1321557419_n
সেরিনা বেগম তার এই শিক্ষা তাঁর সন্তানের মাঝে সঞ্চার করতে চান। যাতে তারাও এই কৌশলটা শিখে কিছু একটা করতে পারে। কাঁথা সেলাই ছাড়াও সেরিনা বেগম বাড়ির উঠানে বিভিন্ন ধরনের সবজি তথা চাল কুমড়া, শিম, পুঁইশাকম লাউ চাষ করেন। এসব চাষ করে পরিবারের সবজি চাহিদা পূরণের পাশপাশি বাড়তি আয়ও হয় বলে তিনি জানান।

এভাবেই নিজের ইচ্ছাশক্তি, শ্রম ও আত্মপ্রত্যয়ের কারণে অভাবী সংসার থেকে ‘অভাব’কে বিদায় দিতে পেরেছেন সেরিনা বেগম। আয়-রোজগারের সাথে জড়িত থাকায় সমাজ ও পরিবারে তাঁর মর্যাদাটাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁকে দেখে তাঁর গ্রামের অনেক নারী উৎসাহিত হয়ে নিজে কিছু করার জন্য। সেরিনা বেগমের এই উদ্যোগ অন্য এলাকার নারীদের মাঝে প্রেরণা সঞ্চার করুক।

happy wheels 2