আদর বানু কাহিনী

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

সন্ধ্যাবেলায় কোনো গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হাঁটলে বাতাসের সাথে মিশে একটা পরিচিত গন্ধ এসে নাকে লাগে। কোনো বাড়ির উনুনে গৃহবধূ রান্না করছে। কলমী শাকের চচ্চড়ি, ধনে বাটা দিয়ে ছোট মাছের ঝোল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এলেই পরিবারের সকলকে নিয়ে খেতে বসবে। হাতে থাকবে হাতপাখা। সেই পাখা দিয়ে বাতাস করবে প্রিয়জনকে। যে সকল গ্রামে এখনো বিদ্যুতের আলো এসে পৌঁছায়নি সেই সব গ্রামের প্রতিটি ঘরেই এমন চিত্র। তেমনি একজন গৃহবধূ সানকিউড়া গ্রামের আদর বানু। বয়স এখন ৬০ এর কোঠা পেরিয়েছে। বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। কতইবা বয়স হবে তখন, তেরো কি চৌদ্দ। বিয়ে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক আগে। স্বামী ছিলেন কৃষক। স্বচ্ছল ছিল সংসার। একে একে চার সন্তানের মা হলেন তিনি।

স্বামী সারা দিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরতেন। তখন তিনি পাশে বসে অনেক যতœ করে খাওয়াতেন। অভাব কি জিনিস তা কোনদিন টের পাননি। তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সুখেই চলছিল সংসার। হঠাৎ করে স্বামী মারা গেলেন। সংসারে অভাব নেমে আসে। তিনবেলা খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলেন। খাবার যোগাড় করা থেকে শুরু করে সব কিছুই তাকে সামাল দিতে হতো। একবেলা খাবার খেলে আরেক বেলার জন্য চিন্তা করতে হতো। চাল, ডাল, সব্জী, লাকড়ি ইত্যাদি তাকেই সংগ্রহ করে হতো। কারণ স্বামী না থাকায় কৃষিকাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সংসারের উপার্জন করার কেউ ছিলনা। তাই ঘরের কাজ করে বাকি সময়টুকু তিনি বসতভিটার পাশের সামান্য জায়গাতে সবজি চাষ করতেন। আর রান্না করার জন্য লাকড়ি সংগ্রহ করতেন।
11
বাড়িতে গাছপালা তেমন ছিল না। তাই অন্যের জঙ্গলে গিয়ে গাছের ডালপালা সংগ্রহ করে আনতেন। সেই থেকে শুরু হয়েছিল তার লাকড়ি সংগ্রহের কাজ। এখনো চলছে। তিনি বলেন, “আগে সব মাইনষের বাড়িত জংলা আছিল বেশি। খড়ি যোগাড় করতে সময় লাগতোনা, কষ্টও অইতোনা। জংলাত ঢুকলে বাইর অওনের পথ খুইজ্জা পাইছিনা। আর অহন আগের মতো জংলা নাই। খালি সাদা আর সাদা। খড়িও কম পাই।” তিনি আরও বলেন, “কেউ আবার ঢুকতেও দেয়না। হেরারও তো খড়ি লাগে। এই কারণে অহন পাতা হুড়ি। একটা হাছুন (ঝাড়–) আর খাঁচা লইয়া বাইর অই। খাঁচা যে পর্যন্ত না ভরে সেই পর্যন্তই পাতা দলা করি। খাঁচা ভরলে বাড়িত আয়ি। অহন আর আগের মতো শরীরে কুলায়না। বয়স অইছে, পাতা হুরতে কষ্ট অয়। বুকে বেদনা করে। কাশি উডে। সারা শইল্যে ফুসুড়ি উঠছে, এই গুলার জ্বালা যন্ত্রণা আছে না ”?

প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি জ্বালানি সংগ্রহ করে সংসারের চাহিদা পূরণ করছেন। এখন তাঁর বয়স হয়েছে। আগের মতো গায়ে জোড় নেই। তাছাড়া গ্রামীণ বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় লাকড়ি সংগ্রহ করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। আবার প্রত্যেকটি পরিবারেই জ্বালানি চাহিদা রয়েছে। তারা নিজ নিজ জায়গা বা সম্পদ থেকেই তা সংগ্রহ করেন। আদর বানুর বাড়িতে তেমন গাছপালা নেই। যা দিয়ে তিনি জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতে পারবেন। টাকা দিয়ে লাকড়ি কেনারও সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়েই তাকে পাতা, খড়, গোবর সংগ্রহের জন্য অন্যের জায়গায় যেতে হয়।

দীর্ঘদিন যাবৎ পাতা সংগ্রহ করার ফলে এখন তার শরীরে চুলকানি দেখা দিয়েছে। হাঁচি-কাশিও হয়। গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা ঝাড়–র সাহায্যে তিনি সংগ্রহ করেন। পাতা সংগ্রহের সময় যে ধূলা থাকে তা নাকে ঢুকলেই হাঁচি আসে। সেই ধুলা গিয়ে শরীরেও লাগে। তাছাড়া মাটিতে মানুষসহ নানা প্রাণীর মল-মূত্রও থাকে, যা পাতার সাথে উঠে আসে। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকানি দেখা দিয়েছে। তাই গোসলের আগেই তিনি পাতা সংগ্রহ করেন। খাঁচায় ভরে পাতা এনে কুলা বা চালনি দিয়ে মাটি, বালি আলাদা করেন। তারপর বস্তায় ভরে সংরক্ষণ করেন। একদিন পাতা কুড়ালে ২/৩ দিন রান্না করতে পারেন।

শরীরের চুলকানি যখন অসহ্য হয় তখন তার ছেলে ওষুধ এনে দেয়। ওষুধ খেলে কয়েকদিন ভালো থাকেন তিনি। শুধু পাতা নয় তিনি গোবরও সংগ্রহ করেন। নিজের গরু আছে একটি। ফাঁকা জমি বা রাস্তার পড়ে থাকা অন্যের গরুর গোবর সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে ঘুটি তৈরি করেন। তারপর রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। বর্ষাকালে যখন লাকড়ি যোগাড় করতে পারেন না তখন সংরক্ষিত লাকড়ি দিয়েই রান্নার কাজ সারেন।

তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থাকেন। আরেক মেয়ে আদরবানুর বাড়িতেই থাকেন। তবে আলাদা থাকেন। তিনি ছেলের সংসারে থাকেন। পাঁচ জন সদস্যের দরিদ্র পরিবার, এই পরিবারে একমাত্র লাকড়ি যোগানদাতা তিনি।
আদর বানুর মতো অসংখ্য নারী আমাদের গ্রামাঞ্চলে আছেন, যারা প্রতিদিন রান্না করার জন্য এভাবেই লাকড়ি সংগ্রহ করেন। এভাবে কাজ করেই তারা অভ্যস্ত। শরীরের অসুখ বিসুখকে তারা আমলে নেয়না। তাদের কাছে পরিবার পরিজনের তৃপ্তি করে খাওয়াটাই মূখ্য। দুবেলা দুমুঠো খাবার তাদের মুখে তুলে দিতে নিরন্তর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের আদর বানুরা।

happy wheels 2