সাম্প্রতিক পোস্ট

জ্বালানি সমস্যা সমাধানে বায়োগ্যাস প্লান্ট নারীকে দিয়েছে মুক্তি

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা

গ্রামাঞ্চলে ও প্রান্তিক অঞ্চলে জ্বালানির চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিনই অধিকাংশ নারীকেই প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। জ্বালানি সংকট দূর করতে গিয়ে বিনোদনের সময় পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয় নারীকে। নারীরাই পাহাড় কিংবা মাঠে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করে লাকড়ি সংগ্রহ করে, কেউ গাছের ঝড়ে যাওয়া পাতা সংগ্রহ করে, কেউ নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর বা রাস্তার পাশে জন্মানো উজাউড়ি (কলমী) সংগ্রহ করে, কেউ অন্যের বাঁশঝাড়ে গিয়ে কঞ্চি সংগ্রহ করে, কেউ খড় সংগ্রহ করে জ্বালানির চাহিদা মেটায়। তবে এক্ষেত্রে নারীর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বায়োগ্যাস। তবে এর জন্য প্রয়োজন গরু পালন। গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবারই গরু পালন করেন। গরুর গোবর জমিতে জৈবসার ও শুকিয়ে লাকড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব কম পরিবারই গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করে। বায়োগ্যাস ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন গ্রামের সুকাশ চাম্বুগং জানান, “আমি গত দুই বছর আগে গ্রামীণশক্তি সংস্থা হতে বায়োগ্যাস ক্রয় করেছি। প্রতিদিন ৩ বেলা করে মোট ৯ জন মানুষের রান্না হয় এতে। প্রতিদিনের গ্যাস তৈরির জন্য ৮-১০ টি গরুর গোবর ব্যবহার করি। গ্যাস তৈরি হওয়ার পর গোবরগুলো আমি সবজির বাগানে ও ফসলের জমিতে ব্যবহার করি।” তিনি আরো বলেন, “বর্তমানে আমাকে আর লাকড়ি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমি খুব কম সময়ে আমার জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে পাচ্ছি।”

Exif_JPEG_420

Exif_JPEG_420

জ্বালানি চাহিদা একটি চিরাচরিত চাহিদা। মানুষের প্রাত্যহিক চাহিদার একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হলো এই জ্বালানি চাহিদা। পাহাড়ি অঞ্চলে লাকড়ি সহজলভ্য হলেও তা সংগ্রহে অনেক জটিলতা রয়েছে। তারপরও লাকড়ির জন্য তাদের আলাদা খরচের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হাওরাঞ্চলে বিশেষভাবে বর্ষাকালে লাকড়ি বাবদ ৬ সদস্যের একটি পরিবারকে মাসে প্রায় ১০০০-১৫০০ টাকা ব্যয় করতে হয়। যা স্বল্প আয়ের পরিবারের উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

Exif_JPEG_420

Exif_JPEG_420

তাই বায়োগ্যাস তৈরিকেই সবচে’ সহজ কাজ এখন গ্রামীণ কৃষি পরিবারের জন্য। বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রয়োজন। প্লান্টের বিভিন্ন অংশ সমূহ হচ্ছে ইনলেট, ডাইজেষ্টার, গ্যাস চেম্বার, আউটলেট, ফারটিলাইজার বা স্লারী পিট, পানি নিষ্কাশন পথ ও পাইপ লাইন। ইনলেটে গোবর ও পানির মিশ্রণটি যন্ত্রের মাধমে উপযুক্ত পানি ও গোবর দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে পাইপের মাধ্যমে ডাইজেষ্টারে ছেড়ে দিতে হয়। ডাইজেষ্টারের ভিতরে গিয়ে মিশ্রণটি অনুজীবের ক্রিয়ায় গ্যাস প্রস্তুত করে। ডাইজেষ্টারে গ্যাস প্রস্তুত হবার পর এটি ডাইজেষ্টারের উপরোস্থিত ডোমে জমা হয়। ডোমটি বায়ু নিরুদ্ধ এবং ছিদ্র মুক্ত রাখতে এর ভিতরের দিকে বিভিন্ন স্তুরে প্লাস্টার এবং রঙের প্রলেপ দিয়ে রাখা হয়। ডোমে এর ক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস জমা হবার পর এই গ্যাস স্লারীর উপরে চাপ দেয় এবং আউটলেট এর ভিতর দিয়ে ম্যানহোলের বাইরে বের করে দেয়। আউটলেটের স্লারী গ্যাসের উপরে চাপ তৈরি করে এর ফলে সৃষ্ট চাপ গ্যাস চূলায় উপযুক্ত চাপ সহকারে পৌছায়। নিরাপত্তার জন্য এই আউটলেট সবসময় কনক্রিট স্লাব দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত। আউটলেট থেকে নির্গত স্লারী ফারটিলাইজার বা স্লারী পিটে জমা হয়ে উত্তম জৈব সারে পরিণত হয়। এই জৈব সারে খড়, রান্না ঘরের বর্জ্য, ঘাস পাতা ইত্যাদি মিশ্রণ করলে সারের গুণগত মান আরো বৃদ্ধি পায়। এভাবে সহজেই বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করা যায়। তবে এক্ষেত্রে বায়োগ্যাস তৈরিতে আগ্রহীদের অবশ্যই গরু পালন করতে হবে। খুব বেশি নয় ৪-৫টি গরু যাদের আছে তারা চাইলে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানির চাহিদা মিটাতে পারেন।

নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রামের ডেনিস ঘাগ্রা তিন বছর যাবৎ বায়োগ্যাস ব্যবহার করেছেন। বায়োগ্যাসের সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন,“ তিন বছর যাবৎ আমরা লাকড়ির কোন খবর রাখি নাই। বাড়িতে গাছের ডালপালাগুলো বিক্রি করে আয় করেছি। বায়োগ্যাস দিয়ে রান্না করাতে রান্নাঘরে কালি পড়েনি। হাড়ি পাতিলে কালি পড়েনি। লাকড়ি কেনা, রৌদ্রে শুকানো ও সংরক্ষণ করার কোন ঝামেলা ছিল না।”
এককথায় বায়োগ্যাস আমাদের গ্রামের প্রান্তীক নারীদের কর্মক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করেছে আর তাদের মুক্তি দিয়েছে জ্বালানি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থেকে।

happy wheels 2