শুটকি খাদ্য-দুর্যোগকালীন খাবার

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল

গ্রামীণ পরিবেশের স্থান ও কালভেদে স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতার ও পদ্ধতির আলোকে দুর্যোগ ও সংকটকালীন সময়ের জন্য পারিবারিক খাদ্য হিসেবে নানা ধরনের সবজি ও মাছসহ খাদ্য সামগ্রী শুকিয়ে “শুটকি” খাদ্য হিসেবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করেন।

উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শীতকালে এই শুটকি খাদ্য তৈরি ও সংরক্ষণের উদ্যোগ দেখা যায়। উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বাড়িতে পারিবারিক শুটকি খাদ্য হিসেবে নানা ধরনের সবজি ও মাছসহ খাদ্য সামগ্রী ব্যবহার ও সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। গ্রামীণ নারী ও পুরুষেরা পাতাকপি, ওলকপি, বীটকপি, বেগুন, আলু, মূলা, কচুশুকনা, কচুরমূল, সজনের ফুল, নিমের ফুল, তেতুল, কুল/বরই, আম, আমের আচার, কুলের আচার, অম্বল মধুর আচার, মসলা হিসেবে ঝাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, টেংরা, পুটি, শোল মাছ, তেলাপিয়া, খয়রা, রুই, মরুল্য প্রভৃতি খাদ্য সামগ্রী শুটকি হিসেবে সংরক্ষণ করেন পরবর্তী সময়ে পারিবারিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
picture-3
ভোজন রসিক বাঙালির নানারকম খাবারের জনপ্রিয় একটি হল বড়া। গাঁয়ের বধুরা আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করেন এ সকল বাহারি বড়া। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ পরিবেশের প্রায় সকল পরিবারে দেখা যায় পারিবারিক পুষ্টি খাদ্য হিসেবে বাহারি বড়ার সমাহার। বিশেষ করে গ্রামের নারীরা লোকায়ত জ্ঞান প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এসকল বড়া তৈরি করেন। শীতকালে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বড় একটি অংশ হল এই বড়া। কুমড়া বড়া, ওলকপির বড়া, ডালের বড়া, আলুর বড়া, কচুর বড়া, বেগুনের বড়াসহ প্রভৃতি বড়া তৈরি করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করেন পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করার জন্য।

গরমের মৌসুমে প্রচুর তাপমাত্রার কারণে এবং মিষ্টি পানির অভাবে সবজি উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এজন্য এসকল শুটকি খাদ্য দুর্যোগকালীন সময়ে অর্থাৎ গরমের মৌসুম ও বর্ষাকালে বিশেষ করে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে পারিবারিক খাদ্য হিসেবে সংরক্ষণ এবং ব্যবহার করেন।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক প্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রানী ও ফরিদা পারভীন বলেন, “শীতকালীন যে সকল সবজির বাজার মূল্য কম থাকে, সবখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং অল্প দিন পরে ফুরিয়ে যায়, সে সব সবজি পরবর্তী সময়ে খাওয়ার জন্য শুটকি হিসেবে রাখা যায়। এসব সবজির কোনটা কেটে কুচি কুচি করে বা কোনটি গুড়া করে রোদে শুকিয়ে বোয়েম জাত বা পলিথিন ব্যাগে করে রাখতে হয়। এসব খাদ্য সামগ্রী স্বাস্থ্যগত মান একদম নষ্ট হয় না। অনেক উপকারী এবং খাবারের খুব স্বাদ লাগে। তাছাড়া এক সময়ের /মৌসুমের খাবার আরেক সময়ে খেতে খুব ভালো লাগে।”
picture-1
দুর্যোগকালীন খাদ্যসংকট নিরসনে শুটকি খাদ্য সংরক্ষণ একটি লোকায়ত পদ্ধতি। কেননা এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে করা হয়। এসকল খাদ্য সামগ্রী রোদে শুকানো হয় এবং এর জন্য কোন প্রকার ঔষধ ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে বোতল, বোয়েম, পলিথিন বা কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয়। প্রয়োজনীয় সময়ে বা পারিবারিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার সময় অর্থাৎ রান্নার সময়ে এর কোনটি আগেই ভিজিয়ে রাখতে হয়। আবার কোনটি গরম পানিতে ধুয়ে নিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী সবজিসমুহ রান্না করা হয়। সবজি ও মাছ ছাড়া অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী ব্যবহার/খাবার জন্য স্বাভাবিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। গ্রামীণ নারীদের শুটকি খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে পারস্পারিক আদান প্রদান প্রথা ও সম্পর্ক উন্নয়ন তরান্বিত হয়। কেননা এসকল খাদ্যসামগ্রী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা এবং এক আত্মীয় থেকে অন্য আত্মীয়দের কাছে পৌছে যায়। বাড়িতে অতিথির আগমনীতে এসকল খাবার সামগ্রী একটি বিশেষ গুরত্ব বহন করে। খাবারের তালিকায় বিভিন্ন বড়া ও শুকটি খাদ্য রাখাটাই একটি আতিথেয়তা ও সংস্কৃতির অংশ।

লোকায়ত পদ্ধতিতে অনেক গ্রামীণ নারী নিরব নিভৃতে দুর্যোগকালীন খাদ্যসংকট নিরসনে পারিবারিক খাদ্য হিসেবে শুটকি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে চলেছেন। নারীর নিজস্ব জ্ঞানপ্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রয়োজন। তাহলে বাঁচবে ঐতিহ্য, টিকে থাকবে দেশীয় সংস্কৃতি।

happy wheels 2