মানুষকে নিয়ে কাজ করতে আনন্দ পাই

সিলভানুস লামিন

এক.
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ রয়েছেন যারা আনন্দ পান, খুশি হন অন্যের সুখ ও ভালো দেখে। কোন মানুষকে উপকার করতে পারলে, কারও জন্য কিছু করতে পারলে তাঁরা মনের ভেতরে শান্তি খুঁজে পান। তাঁদের নিজের স্বার্থ কখনও বাধা হতে পারে না তাদের কল্যাণমূলক কোন কাজে। মানুষের জীবনের সার্থকতা তখনই আসে যখন তারা কোন কিছু প্রত্যাশা না করে অন্যের জন্য কল্যাণমূলক কিছু করতে পারেন। এজন্য তো বলা হয় “আমরা সবাই পরের তরে”। স্বার্থহীন এসব মানুষের কারণে পৃথিবী আজও কত সুন্দর, আজও কত উপভোগময়। প্রতিদিন হাজারো নেতিবাচক ঘটনার মধ্যেও এখনও কিছু কিছু ইতিবাচক ঘটনা রয়েছে যা মানুষকে বাঁচার, নতুন কিছু তৈরির করার অনুপ্রেরণা দেয়, দেয় সাহস, জাগ্রত করে মানুষের মানবতাবোধকে। এরকমই একটি মানবিক উদ্যোগ সম্প্রতি জেনেছি রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নে। এই মানবিক উদ্যোগের দ্রষ্টা হচ্ছেন রহিমা বেগম। মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কোন কিছু করার তাগিদ মন থেকে উপলদ্ধি করে যিনি স্বার্থহীনভাবে ঝরে পড়া শিশু, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের আগলে ধরেছেন, তাদের সেবা করে গেছেন, অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন এবং সর্বোপরি তাদের সার্বিক মঙ্গল কামনায় যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এসব দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের সেবা করার জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যার নাম ‘দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতি’। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের নারী বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধিত।
img_5242
দুই
রাজশাহীর পবা উপজেলা থেকে বড়গাছি ইউনিয়ন খুব বেশি দুরে নেই। বড়গাছি পাড়াতেই রহিমা বেগমের বাস। পাশেই একটি বড় বট গাছ। বটগাছকে উপলক্ষ্য করেই সেখানে একটি বাজার বসেছে, যা বড়গাছি বাজার নামেই পরিচিত। বাজার থেকে রহিমা বেগমের বাসার দূরত্ব বড়জোর কয়েক গজ হবে। তাই বাজারের নানান মানুষের শব্দ, হাক-ডাক তাঁর বাসা থেকে শোনা যায়। কিন্তু কোন কোলাহলই তাকে থামাতে পারেনি মহৎ কাজ করার জন্য। রহিমা বেগমের বাসায় প্রবেশ করার সাথেই সাথে তিনি হাস্যমূখে আমাদের বরণ করে নেন। আমরা তাঁর সন্তানদের সমবয়সী হবো ভেবে কি না তিনি আমাদের ‘বাবা’ সম্বোধন করে বসতে দেন। তাঁর কাছ থেকে এই আন্তরিকতা পেয়ে আমরাও জড়তা দূর করে শুরু করি আলাপন; একটি ঘরোয়া আলাপন যেখানে সুঃখ, দুঃখ, কষ্ট, বেদনার কাব্যগুলো উন্মোচিত হয়; প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির আনন্দ ও বেদনাগুলো মূর্ত হয়। আলাপনের প্রথম বাক্যটিই সাজিয়েছি এভাবে “কেন আপনি এমন কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন? তাঁর উত্তর, “তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের ‘ব’ বুঝে উঠার আগেই আমি সংসারের বিশাল দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি। তাই আমি ভালো করেই জানি বাল্য বিয়ে একটা কিশোরীর জন্য কতটা বেদনার, কষ্টের হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “একটি এনজিওতে চাকুরি করার সুবাদে প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখে আমি সত্যিই মর্মাহত হয়েছি। অনেক নারী সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সেবা থেকে বঞ্চিত। তাদের অবস্থা দেখে আসার পর থেকে আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি কেন এসব নারী অধিকার ও সেবা থেকে বঞ্চিত হবে?” তিনি বলেন, “তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু করার। যে সংগঠনে চাকুরি করি সেখানে থাকলে আমি স্বাধীনভাবে এইকাজ করতে পারতাম না। তাই চাকুরি থেকে ইস্তফা নিয়ে ১৯৯৯ সালে দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতি গঠন করি। স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনের ব্যানারে গ্রামের নারীদের সেবা করার চেষ্টা করি।”

তিন
সামাজিক ব্যাধি তথা যৌতুক, বাল্য বিয়ে, নারী ও শিশু নির্যাতন সবসময়ই রহিমা বেগমকে মর্মাহত করতো। যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। গ্রামের নারীদেরকে সচেতন করে তোলার কাজ শুরু করেন। বাল্য বিয়ের আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানানোর সাথে সাথে তিনি বাল্য বিয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা কথা তুলে ধরেন। এভাবে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেকে সচেতন হয়ে বাল্য বিয়েকে ‘না’ বলেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫০টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে সফল হয়েছেন বলে তিনি জানান। নারীদের সচেতন করে তিনি যৌতুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। যৌতুককে কেন্দ্র করে সংঘটিত নারী নির্যাতন বন্ধে তিনি প্রশাসনহ নানান মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছেন। এভাবে তিনি এ পর্যন্ত ৫০০টির মতো নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করতে ভূমিকা রেখেছেন। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিনিধি ও দফতরের সাথে যোগাযোগ করেন; বঞ্চিতদের সুযোগ-সুবিধা ও সেবা পাইয়ে দিয়েছেন। এখনও প্রতিদিনই তাঁর কাছে ফোন আসে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নানান আইনগত সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন আইন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে যোগযোগ করেন। বিনা পয়সায় দরিদ্র নারীদের আইনসেবা পাইয়ে দিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এছাড়া সরকারিভাবে আয়োজিত সচেতনতামূলক, সক্ষমতা উন্নয়ন ও জীবিকা উন্নয়ন বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণে বঞ্চিত নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে রেখেছেন ভূমিকা। তাঁর হস্তক্ষেপে অনেক নারী এসব প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে নিজের ভাগ্যের উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতন হয়েছেন; পেয়েছেন বিভিন্ন ধরনের সেবা ও সুযোগ। তিনি শুধু এ কাজ করে ক্ষান্ত হননি; বরং তাঁর অবর্তমানে এসব সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একই ইউনিয়নে আরও ২০টি সহসংগঠন তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। এসব সংগঠন তাঁর দেখানো আদর্শকে উপজীব্য করে সমাজ সচেতনমূলক কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বিশেষ করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

img_5245

চার
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশুদের জন্যও তাঁর হৃদয় কোণে রয়েছে ভালোবাসা ও স্নেহ। চিন্তা করতেন কীভাবে ওইসব শিশুদের সেবা করা যায়! অনাথ ও পথশিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য তিনি ‘ফুলকুড়ি শিশু একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজের বাসার একটি কক্ষে শুরু করেন শিক্ষা কার্যক্রম। এই একাডেমিতে পড়তে আসে অনাথ, নিম্নমধ্যবিত্ত, কর্মজীবী নারীর শিশুসহ পথশিশুরা। অনাথ ও পথশিশুদের এই একাডেমিতে বিনা বেতনে পড়ানো হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা শুরু করে অনেক শিক্ষার্থী এখন ভালো অবস্থানে আছেন বলে তিনি জানান। তিনি গর্ব করে বলেন, “আমার এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শুরু করে মনিরা, বিউটি, রাশিদা, ডলিরা এখন কলেজে পড়ছে। তাদের এই উন্নতি দেখে আমরা সত্যিই গর্ব হয়।” এছাড়াও তাঁর গড়ে তোলা একাডেমিতে প্রথমদিকে শিক্ষকতা করতেন স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা,যাঁরা এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো একটি অবস্থানে রয়েছেন। শিক্ষার আলো সবার মাঝে বিচ্ছরণ করার জন্য রহিমা বেগমের এই উদ্যোগ ক্ষুদ্র হলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নিজে একসময় টিউশনি করে সংসার চালানো রহিমা বেগমের এমন মহৎ কাজ দেখে সরকারি ও বেসরকারি অনেকগুলো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাঁর গড়ে তোলা ‘দুস্থ মহিলা কল্যাণ সমিতি’ এবং ‘ফুলকুড়ি শিশু একাডেমী’ পরিদর্শন করেছে। রহিমা বেগমের এই উদ্যোগ তাঁকে প্রশংসা কুড়িয়েছে তো বটেই উপরোন্তু স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া দূর্নীতি দমন কমিশন, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন। এসব স্বীকৃতি ও সম্মাননা তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে।

পাঁচ
সমাজ সচেনতমূলক এসব কাজে রহিমা বেগম সবচে’ বেশি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন পরিবারের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “আমার পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এসব কাজ করা কখনও সম্ভব হতো না। আমার স্বামী ও  সন্তানেরা আমাকে সবসময় উৎসাহ  দেন, পরামর্শ দেন।” রহিমা বেগমের স্বামী মো. শামুদ্দিন একজন চাকুরিজীবী। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ই শামসুদ্দিনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি ও তাঁর স্বামী দু’জনেই পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের ঘরে তিন ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। তাঁর বড় ছেলে বিএ পাস, মেজো ছেলে এমবিএ শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাকুরি করেন এবং ছোট্ট ছেলে এখনও পড়াশোনা করছেন। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। সমাজ সচেতনমূলক কাজের অবসরে রহিমা বেগম গান গান। তিনি নিজে গান লিখে সেই গানের সূরও তিনি নিজে করেন। এক সময় তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেন।

happy wheels 2