শহীদ মিরাজ : পোলভল্টের মাঠ থেকে অস্ত্র কাঁধে এক মুক্তিযোদ্ধা

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক:
আগের প্রজন্ম মোটামুটি চিনলেও পরের প্রজন্মের কাছে শহীদ মিরাজ শুধুই সাইনবোর্ডে ঝোলানো একটি নাম। তারা জানেনা তার বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ী জীবন কিংবা যোদ্ধাজীবনের একটি বর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এই বীরকে জানবার জন্যও যে খুব বেশি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বা প্রচেষ্টা রয়েছে তেমনও না। একাত্তরে এই তরুণ ধ্যান জ্ঞান সব কিছুই উৎসর্গ করেছিলেন তার পোলভল্টের বাঁশের লাঠিতে কিন্তু মার্চের বিভীষিকাময় সে রাতের পর কোথায় যেন হারিয়ে গেলো এই প্রতিভাবান এ্যাথলেট। ক্রীড়াঙ্গনে উৎসগীকৃত প্রাণ, সুঠাম দেহ থেকে জন্ম নিলো এক দুরন্ত মুক্তিযোদ্ধা, নাম তার এ কে এম মিরাজ উদ্দিন।
miraj-pic
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে জন্মেছিলেন এই বীর যোদ্ধা। মাত্র ১১ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবা শরীফ উদ্দিন আহমেদকে। বিধবা মা মোসাম্মত হাজেরা খাতুন তাঁকে তিল তিল করে বড় করেছেন । লেখাপড়ার হাতে খড়ি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি পেরিয়ে হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুলে। এখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। এরপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

অসাধারণ গড়নের সুদর্শন মিরাজের প্রিয় ইভেন্ট ছিল পোলভল্ট, হার্ডলস এবং লং জাম্প। ১৯৬৩ সালে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে এ তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলেন মিরাজ। ১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাতেও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং লং জাম্পে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ১০ম পাকিস্তান অলিম্পিকে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন মিরাজ। ১৯৭০ সালে একই সালে করাচী হকি কাব মাঠে অনুষ্ঠিত ১২তম পাকিস্তান জাতীয় গেমসে ততকালিন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাদের সেরা এ্যাথলেট হিসেবে মিরাজকে স্বীকৃতিও দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিরাজ উদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ। কিন্তু তাঁর যাওয়া হয়নি। ২৫ মার্চের কালো রাত্রি সব কিছু উল্টে দেয়। ২ নভেম্বর ১৯৭১ যুদ্ধজয়ের নেশায় উন্মত্ত মিরাজদের উপর দায়িত্ব পড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার। রাতের আঁধারে শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু বিধি বাম। ব্রিজে ডিনামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান মিরাজ। তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৮ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর ডিরেক্টর মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে মুক্ত করে পাকবাহিনীর জীপে করে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আজও কোন খোঁজ মেলেনি মিরাজের। স্বাধীনতার ৪৫ টি বছরেও মিরাজের পরিবার খুঁজে পায়নি তার লাশের ঠিকানা, কবরের কোন চিহ্ন। স্বাধীনতার এতবছর পরও জাতীয়ভাবে তো নয়ই তাঁর জন্মভূমি মানিকগঞ্জেও আলাদা করে খুব একটা তাঁকে স্মরণ করা হয়নি। মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামফলকে শহীদ তপনের সাথে যৌথভাবে আছে তাঁর নাম শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম হিসেবে। জাতীয়ভাবেই এই বীরদের স্মরণ করা উচিত বলে মনে করেন এলাকাবাসীসহ সচেতন মহল।

happy wheels 2