গরুর “লাঙল-জোয়াল-মই” শুধু কাঠের যন্ত্রপাতিই নয়! হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিও

সাতক্ষীরা থেকে আসাদুল ইসলাম

এক সময় কৃষকের কাছে ‘হালের বলদ’ ছিল মূল্যবান সম্পদ। প্রযুক্তির কল্যাণে বলদের সেই হালের লাঙলের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ‘কলের লাঙ্গল’। তাই কৃষক পরিবারও ছুটছে সেই প্রযুক্তির পেছনে। ফলে বাঙালির চিরচেনা ঐতিহ্য গরু, লাঙল ও জোয়াল কালের পরিক্রমায় আজ বিলুপ্তির পথে।

ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সাথে সাথে কৃষিতে আধুনিকায়ন শুরু হলেও সেটি আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এর বিকাশ এবং বিস্তার শুরু হয়। ফলে কালের পরিক্রমায় বদলে গিয়ে গরু টানা লাঙলের পরিবর্তে এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে কৃষি কাজে। এখন কৃষি পরিবারে হালের গরু না থাকায় ভোরে মাঠ চষে বেড়ায় না কোনো রাখাল বালকও। শোনাও যায়না তাদের বাঁশির সুর। কিংবা সন্ধ্যার গোধূলি লগ্নে সেই রাখাল বালকও গ্রামের মেঠোপথ ধরে গরু নিয়ে বাড়ি ফেরে না। সব কিছু বদলে গেছে কেবল প্রযুক্তির ছোঁয়ায়।

langoljpg
একটা সময় দেখা যেত খুব ভোরবেলায় কৃষক তার ঘাড়ে লাঙল জোয়াল আর মই রেখে একহাতে গরু শাসনের পাচুনি লাঠি আর অন্যহাতে চাষাবাদের উপযুক্ত ষাঁড়ের দড়ি নিয়ে ছুটে যেতো ক্ষেতে। চাষের মধ্যে একটু সময় করে কাদামাখা শরীরে ক্ষেতের আইলে সকালের পান্তা আর কাঁচা মরিচ ও পিয়াজ দিয়ে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতো। বিশ্রাম শেষে আবারও কৃষকের ঠাঁই ঠাঁই শব্দ শোনো যেতো। আবার কখনো কখনো নিজের সন্তানকে মইয়ে বসিয়ে চাষাবাদের জমি সমান করতো। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না।

সাতক্ষীরা সদরের সুডুরডাঙ্গী গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, “গরুর লাঙল, জোয়াল, মই এখন আর দেখা যায় না। একটা সময় এটাই ছিলো কৃষকের চাষের মাধ্যম। কিন্তু আজ কলের লাঙ্গল থাকায় তা হারিয়ে গেছে।” তিনি আরো জানান, “তার নিজেরও হালের গরু ছিলো। সকালে উঠে মাঠে চাষ করতে যেতেন। আজ এসব শুধু স্মৃতি। কারণ হালের গরু পালন করতে গেলে প্রচুর খরচ হয়। আবার অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয় এই গরু। তারপর আবার এ দিয়ে চাষ করতে সময়ও লাগে বেশি। তাই এখন আর এসব দিয়ে চাষ করি না। তবে যাদের অল্প জমি তারা এখনো এই কাঠের লাঙল দিয়ে চাষ করে।”

কিছু দিন আগেও চাষাবাদের উপকরণ হিসেবে হালের গরু, মই ও লাঙল ছিল কৃষকের একমাত্র ভরসা। আর এসব ছাড়া গ্রামবাংলায় চাষাবাদের কথা চিন্তাই করা হতো না। কিন্তু আধুনিক যুগে চাষাবাদের যান্ত্রিক উপকরণ আবিষ্কারের প্রভাবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে জোয়াল, মই ও হালের বলদ। এসবের ব্যবহার স্বল্প আয়ের কিছু সংখ্যক কৃষক পরিবারে এখনও কোন রকমে টিকে আছে। তবে সেটা খুবই সামান্য।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন কৃষিকাজে গরুর পরিবর্তে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। আর কৃষিকাজে ব্যবহৃত গরু, লাঙল, জোয়াল ও মই বিলুপ্ত হতে চলেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কৃষিকাজে ঠাঁই করে নিয়েছে পাওয়ারটিলার ও ট্রাক্টর। তাই জমিতে কৃষকের হালের গরু, লাঙল ও মই দিয়ে চাষাবাদের দৃশ্য এখন শুধু ডুমুরের ফুলের মত। এখন আর গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে কালের স্বাক্ষী লাঙল, জোয়াল, মই ইত্যাদি সরঞ্জামের পসরা সাজিয়ে বসতে দেখা যায় না। অতীতের সেই কামারের ঠক ঠক শব্দ আর কানে আসে না। যারা এগুলোকে পেশা হিসেবে নিয়ে তৈরী করতেন তাদেরও অনেকেই এখন বেকার।

তবে অনেকে মনে করে পর্যাপ্ত ক্ষেত খামার না থাকায় এবং চাষের জমি বাদ দিয়ে ঘের করার কারনেও এটি আজ বিলুপ্তির পথে। তাই তারা মনে করে ঐতিহ্যবাহী এই চাষাবাদের গ্রামবাংলার পুরনো লাঙল, জোয়াল, মই ও হালের গরুর ব্যবহার বন্ধ সহ এর বিলুপ্তি ঘটবে এবং এক সময় তা কালের সাক্ষী হিসাবে স্থান পাবে কোন জাদুঘরে অথবা শুধুমাত্র বইয়ের পাতায়।

happy wheels 2