প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রকৃতি নির্ভরশীলতাই কুসুম রাণীর সংগ্রামী জীবনের মূলমন্ত্র

কয়রা, খুলনা থেকে ঘুরে এসে মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদার

কৃষি, প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, বন, নদী যেমন স্থিতিস্থাপক, সহনশীল এবং সর্বংসহা ঠিক তেমনি প্রতিটি নারীই বুঝি তেমনই। তাইতো নারীকে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি এবং  প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারীর শিক্ষা গ্রহণ হয় প্রকৃতির কাছ থেকে। ভেঙে পড়া কাকে বলে সেটি মনে হয় নারীদের জানাই নেই। শত প্রতিকূলতায় যেন তাদের জীবনীশক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। নতুন নতুন কৌশল এবং পরিকল্পনায় এগিয়ে যায়। বিজয়ী হয়ে ওঠে জীবন সংগ্রামে। তেমনই এক বিজয়ী নারীর গুল্প শুনাবো আজ।

বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদের দূর্যোগপ্রবণ কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের কুসুম রাণী। স্বামীর পৈতৃক ২ বিঘার বসতভিটা ও এলাকার নদী-বন ও কৃষিকে আঁকড়ে ধরে কুসুম রাণী ও স্বামী গৌরিপদ মল্লিক স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন। কিন্তু ২০০৫ সালে গৌরিপদ মল্লিক রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যান। পরিবারের প্রধানের আবষ্মিক মৃত্যুতে কুসুম রানীর পক্ষে সংসার চালানো ব্যাপক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

1
এরপর শুরু হয় কুসুম রাণীর সংগ্রামী জীবনের পথচলা। আর এ পথচলায় শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে রপ্ত করা কৃষি জ্ঞানকে অবলম্বন করে ৩ সন্তানসহ নিজের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে কুসুম রাণী। বিয়ের পর কুসুম রাণী তার শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে শেখা মাদুর তৈরির জ্ঞান নিয়ে পরিবার নির্বাহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজের বসতভিটার ৫ কাঠা জমিতে ‘মেলে’ (এক ধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ-যা দিয়ে মাদুর তৈরি করা হয়) চাষ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে বালিয়াডাঙ্গা নারী উন্নয়ন সংগঠনের সভাপতি শিখা রাণীর মাধ্যমে বারসিক’র সাথে কুসুম রাণীর যোগাযোগ হয়। বারসিক কর্মীদের সাথে কুসুম রাণী তার পরিকল্পনার কথা জানান।

পরবর্তীতে ২০১১ সালে বারসিক থেকে কুসুম রাণীকে মেলে চাষে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। প্রথম বছরে কুসুম রাণীর জমিতে যে পরিমাণ ‘মেলে’ উৎপাদন হয়; তা থেকে নিজেই মাদুর তৈরি করেন এবং বাজারে বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ১০ কাঠা জমিতে মেলে চাষ শুরু করেন। এছাড়া, বসতভিটায় সারাবছর বিভিন্ন রকম সবজি জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদন করে পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রতিবেশী ও বাজারে বিক্রি করে সংসারের নানান চাহিদা পূরণ করেন।

mele 2
মেলে’র পাশাপাশি বসতভিটার অন্যান্য অংশে পুঁইশাক, ঢেঁড়ষ, তরুল, কুশি, ঝিঙ্গা, বরবটি, লাউ, শসা, কুমড়া, কুচুরমুখি, ওল, সীম, লাল শাক, পালং শাক, কলমি শাক, ঝাল, আদা, হলুদ ইত্যাদি সবজি চাষ করেন। পাশাপাশি এ সমস্ত ফসলের বীজও সংরক্ষণ করেন। এছাড়া, তিনি তার বসতভিটার বিভিন্ন অংশে তাল, নারিকেল, খেজুর, আম, জাম, জামরুল, কদবেল, বরই, সুপারি, ছবেদা, লেবু, মেহগনি, তেতুল, শিশুফুল, বাবলা, কাঁঠাল প্রভৃতি ফলজ ও বনজ গাছ সংরক্ষণ করছেন। শ্বশুরের পরামর্শে কুসুম রাণী তার বসতভিটার এক পাশে প্রায় ৫ কাঠা জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করেন। স্থানীয় প্রজাতির রুই, সিলভার কার্প, কাতলা, মৃগেল, পুঁটি, শোল, ট্যাংরা, মৌরুল্য, কই ইত্যাদি মাছ তার পুকুরে সংরক্ষণ করেছেন। এভাবেই তার পরিবারের সারাবছরের শাক-সবজি, ফল ও মাছের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও শুকর পালন করেন অবশিষ্ট আমিষ এবং অর্থের চাহিদা মেটানোর জন্য।

২০১৪ সালে কুসুম রাণী বারসিক’র সহযোগিতায় তার ভিটার ৩ শতক জায়গায় স্থানীয় ফলজ ও বনজ গাছের নার্সারি করেন। এই প্রসঙ্গে কুসুম রাণী বলেন,“স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের মানুষ (বড়) করেছি। প্রতিদিন মাটি কাটা, ধান রোয়া, রাস্তার কাজ, নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে পরিবারের ৪ জন মানুষের খোরাকি পূরণ করেছি। ২ মেয়ের বিয়ের যাবতীয় খরচ করেছি বাড়ির ফল, সবজি, মাছ বিক্রি ও জোন-মুজরির টাকায়।” তিনি আরো বলেন, “প্রতিদিন সকালে কাজ করতে যাই। দুপুর ২টার সময় বাড়ি ফিরে এসে রান্না করি। বিকালে নিজের ক্ষেতে কাজ, হাঁস-মুরগি ও শুকর দেখাশুনা এবং মাদুর বোনার কাজ করি। দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছি সন্তানদের সুখে রাখার জন্য।”

3
বর্তমানে তার বসতবাড়ির খামার থেকে বিভিন্ন রকম ফল ও কাঠ গাছ, মাছ, পশুপাখি, মেলে ও সবজি থেকে পরিবারের ৭০-৮০ ভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। বাকিটা নিজে জন-মুজরি দিয়ে যা উপার্জন করেন। তাতে মোটামুটি ভালোভাবে পারিবার চলে যাচ্ছে। কুসুম রাণীর জীবন এবং তাঁর বসতবাড়ি এখন মানুষের মুখে মুখে। প্রতিদিন তার বাড়িতে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে লোকজন এসে দেখে যায়। কুসুম রাণীর কাছ থেকে বীজ, ফল, সবজি এবং পরামর্শও নিয়ে যায়। তিনি বলেন, “আমি নিজে বিভিন্ন সবজির বীজ সংরক্ষণ করি এবং অন্যদের মাঝে বিনিময় ও বিনামূল্যে বিতরণ করি”।

কোন পরিবারের স্ত্রী মারা গেলে, স্বামীর পক্ষে সন্তানদের সঠিকভাবে লালন পালন করা আমাদের সমাজে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু স্বামী মারা গেলে, একজন নারী তার সন্তানদের সঠিকভাবে লালন পালন করার সফলতার অনেক উদাহরণ আমাদের সমাজে রয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্থানীয় কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্যকে আকড়ে ধরে তিন সন্তানসহ নিজের সংগ্রামী জীবনের সার্থকতা ও সফলতার এক উজ্বল দৃষ্টান্ত উপকূলীয় কয়রা জনপদের কুসুম রাণী। প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি প্রতিষ্ঠা করে, ইতোমধ্যে, কুসুম রাণী এলাকার অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের কাছে শ্রদ্ধা অর্জনসহ শিক্ষা গ্রহণের এক প্রকৃতির পাঠশালা তৈরি করেছেন।

আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কুসুম রাণীকে। কুসুম রাণীর সংগ্রামী জীবনে উদ্বুদ্ধ হোক আরো অসংখ্য নারী। গড়ে তুলুক প্রকৃতি এবং মানুষের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক এবং আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক।

happy wheels 2

Comments