লবণ মাটিতে কুয়া পদ্ধতির চাষ

সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদার

ভাবতে অবাক লাগে জলের দেশেই জলের আকাল। জল ছাড়া জীবন চলেই না। প্রতিটি প্রাণ এবং ফসল চাষের জন্য সুপেয় পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এর মাধ্যমে প্রাণ ও ফসলের অস্তিত্ব রক্ষা পায়। তবে দিন দিন সেই জলের আধার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বৈরী জলবায়ু ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে। যার প্রভাবে পরিবর্তন এসেছে মানুষসহ সব জীবের জীবনে। সুপেয় জলের আরেকটা উৎস হচ্ছে আমাদের ভ’গর্ভস্থ। উৎস্য যাই থাকুক না কেন, এ জলের কারণে আমাদের জমির ফসল উৎপাদন হয়।
1
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে বর্ষা মৌসুমে আমন ফসল ছাড়া অন্য ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। শ্যামনগর উপজেলার অধিকাংশ স্থানের নীচের পানি লবণাক্ততার ফলে হাজার হাজার বিঘা কৃষিজমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এই লবণাক্ততাকে মোকাবিলা করার জন্য শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের পাতড়াখোলা গ্রামের কৃষকরা হুলোর বিলে পুকুর খনন ও কুয়া পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো মৌসুমে ধান চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। স্থানীয় কৃষকরা বোরো ধান চাষ করার সময় পুকুর, খাল, কুয়ার পানি ব্যবহার করেন।

লবণ মাটিতে ফসল ফলানোর জন্য এলাকার কৃষকেরা দিনরাত নানা পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকেন। তাদের এই পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্যতম ফসলই হচ্ছে এ কুয়া পদ্ধতির চাষ। এটি লবণ মাটিতে ফসল ফলানোর এক উপকূলীয় চর্চা। কুয়া পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো মওসুমে ধান চাষ সম্পর্কে শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের পাতড়াখোলা গ্রামের মো. মমিন আলী বলেন, “১৫/২০ বছর ধরে জমির এক সাইডে কুয়া কেটে বোরো ধান চাষ করি। এক বিঘা জমিতে দুই কর্ণারে দুইটি কুয়া কেটে বোরো ধান চাষ করি। জমি পাকের পানিটা অন্তাখালীর খাল থেকে নেওয়া হয়। তারপর কুপ থেকে পানি নিয়ে বোরো ধান চাষ করি।” তিনি আরও বলেন, “কুয়া লম্বা ৮ ফুট, চওড়া ৭ ফুট এবং গভীরতা ৬/৭ ফুট। প্রতিদিন তিনবার (সকাল, দুপুর, বিকাল) পানি উঠানো যায়। প্রতিদিন সকালে পানি ভর্তি থাকে কিন্তু দুপুর ও বিকালে একটু পানি কম উঠে। মাঘ মাস পর্যন্ত কুপে ভালো পানি পাওয়া যায়। কিন্তু ফাল্গুন মাস থেকে পানির লেয়ার কমতে থাকে এবং ফাল্গুন মাসের ১৫ তারিখের পরে আর পানি পাওয়া যায় না”। তিনি বলেন, “সর্বপ্রথম এই বিল থেকে কুয়া কেটে পানি তোলা হয়। তারপর আস্তে আস্তে কুয়ার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে পাতড়াখোলা গ্রামের হুলোর বিলে ৫শত বিঘা জমিতে পুকুর ও কুপের পানি দিয়ে বোরো ধান চাষ হচ্ছে।”

3
একই গ্রামের রব্বানী বলেন, “আমি সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি হারি (লিজ) নিয়ে বোরো ধান চাষ করছি। বিঘা প্রতি ২ হাজার টাকা হারি দিতে হয়। প্রত্যেকটি জমির কোনায় কুপ খনন করেছি। তবে ৫ কাঠা জমিতে একটু বড় করে কুপ খনন করার চেষ্টা করেছি। ১৫ ফুট গভীর করার পর লবণ পানি উঠতে দেখা যায়। শেষের দিকে পানির একটু ঘাটতি পড়ে। তখন পুকুর থেকে পানি এনে জমিতে সেচ দেওয়া হয়।” তিনি আরও বলেন, “পুকুর থেকে পানির সেচ দিতে গেলে বিঘা প্রতি আবার জমির মালিককে এক হাজার টাকা বেশি দিতে হয়। অনেকে পানির কোন ব্যবস্থা না থাকাই ঐ অবস্তায় ফেলে রাখেন। তবে যদি ফাল্গুন মাসে কোন রকম এক পসলা বৃষ্টি হয় তা হলে আর পানির সংকট দেখা দেয় না। পুনরায় ১০/১৫ দিন কুপ থেকে পানি পাওয়া যায়। তাতে ভালোভাবে ধান হয়ে যায়”।

4
কুয়া পদ্ধতিতে ফসল চাষ করে লবণাক্ত অঞ্চলের পরিবারে ফিরেছে বাড়তি খাদ্য ও সচ্ছলতা। পাতড়াখোলা গ্রামের নাজমা বেগম বলেন, “আমি দিন মজুরের কাজ করি। জমি বর্গা নিয়ে কুপ পদ্ধতির মাধ্যমে ধান চাষ করি এবং যে ফসল পাই তাতে ছয় মাসের খোরাকি হয়ে যায়।”

ভৌগলিক ও অঞ্চলগত কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ত। উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষেরা বসবাস শুরু করার আগে থেকেই সুপেয় পানির সমস্যা ছিল। লবণাক্ততা মোকাবেলায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কুপ খনন করে বোরো মৌসুমে ধান চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানীয় অভিযোজন চর্চা। লবণ পানির চিংড়ী চাষ উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি যেখানে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সেখানে পাতড়াখোলা গ্রামের কৃষকদের পুকুর ও কুপ পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো মৌসুমে ধান চাষ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে অনেক ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments