শ্মাশানের জায়গা পেল হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবার

তানোর থেকে অসীম কুমার সরকার

SHOSAN 2স্বাধীনতা পরবর্তী তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের মোহর গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সৎকারের জন্য কোন শ্মশানের জায়গা ছিল না। তাঁরা নিজের বাড়ির পাশে, খোলানে, বাঁশের ঝাড়ে, এমনকি আবাদি জমির আইলে সৎকার করতেন বলে জানান গ্রামবাসী। দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর পর ওই গ্রামের শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ৪৪ শতাংশ সরকারি জায়গা শ্মাশনের নামে বরাদ্দের সংবাদ পেয়ে গ্রামের সকলের মাঝে এক আনন্দঘন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

শনিবার সকালে ওই গ্রামে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শ্মশানের জায়গা পেয়ে নবীন-প্রবীণরা মিলে ১২ শতাংশ পুকুরপাড় ও ৩২ শতাংশ পুকুর মাপজোক করছে এবং মাটি কেটে পুকুর পাড়ের জায়গা ভরাট করে, পবিত্রতার প্রতীক একটি তুলশী গাছ রোপণের মাধ্যমে শ্মশানের সংস্কারের কাজ উদ্বোধন করেন গ্রামের প্রবীণজনেরা। এমন সময় শ্মশানের জায়গা বরাদ্দের খবর শুনে অনেকেই ছুটে আসেন পুকুরপাড়ে। রূপ নেয় সকল প্রজন্মের এক মিলনমেলা।
SHOSAN
এসময় উপস্থিত মোহর গ্রামের সংগীত প্রশিক্ষক শ্রী মিঠুন কুমার দাস আবেগে আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন, “আমার বাবা মঙ্গলা মাহান্ত তানোরের সুপরিচিত সংগীত শিল্পী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি আকস্মিকভাবে মারা যাওয়ায় আমাদের জমির আইলে সৎকার করা হয়েছে। শ্মশান থাকলে বাবার সমাধি করতে পারতাম। আজ শ্মশানের জন্য জায়গা পেয়ে খুব ভালো লাগছে।” তিনি আরও বলেন, “আমার মতো কাউকে আর নিজের বাবা আবাদি জমির আইলে সৎকার করতে হবে না।” মোহর গ্রামের কাঠ মিস্ত্রী শ্রী উপেন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, “কি বলবো দাদা, আমার ছোট বোন প্রতীমা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে জায়গার অভাবে বাড়ির খোলানে মাটি দিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করেছি। আজ শ্মাশানের জন্য জায়গা পেয়ে নিজের হাতে মাটি কেটে একটি তুলশি গাছ লাগিয়ে দিয়েছি। এটা যে কি আনন্দের আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না।” পঁষট্টি বছর বয়সী শ্রীমতি বীণা রাণী বলেন, “বাবা আমার সময় তো শেষ হয়ে এসেছে। আমি ভাবতাম আমি মরে গেলে কোথায় সৎকার করা হবে? আজ এই সংবাদ শুনে খুব আনন্দ লাগছে যে আমার সৎকারের জায়গটি নিশ্চিত হলো।”

মোহর মন্দির কমিটির সভাপতি শ্রী উজ্জ্বল সূত্রধর বলেন, “স্বাধীনের আগে এই জায়গাটি শ্মশানের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করা ও অদৃশ্য বাধার কারণে জায়গাটি আমরা শ্মশান হিসেবে ব্যবহার করতে পারিনি। বর্তমানে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মহোদয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শ্মাশনটি আমরা পুনরায় ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছি। শ্মাশনটি পেয়ে আমাদের গ্রামবাসীরা আজ খুব খুশি। সেইসাথে আমরা জনপ্রতিনিধি ও তানোর উপজেলা প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।”

গবেষণা সংস্থা বারসিক এর সহযোগী গবেষক অমৃত কুমার সরকার বলেন, “মোহর গ্রামের দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা ছিলো শ্মশান,  যা কিনা জননেত্রীত্বের কারণে আজ সমস্যাটির সমাধান হলো। গ্রামের সকল উন্নয়নই হোক জননেত্রীত্বে।”
SHOSAN 3
এনিয়ে তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম মুঠোফোনে বলেন, “শ্মশান করা একটি সোয়াবের কাজ। আমি আত্মার টানেই শ্মশানের জায়গা স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য প্রত্যয়ন দিয়েছি। আশা করি অচিরেই তা স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত হবে এবং বন্দোবস্তের পরে পর্যায়ক্রমে শ্মশান সংস্কারের কাজ করা হবে।

এ বিষয়ে তানোর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোসা. নিলুফা ইয়াসমিন মুঠোফোনে বলেন, আমরা মাপজোক করে এসেছি। কিন্তু পুকুর লিজ দেয়ার একতিয়ার না থাকায় পুকুরপাড়ের জায়গাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশান হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “এছাড়াও খাস-খতিয়ান রেজিস্টারে লালকালি দিয়ে জায়গাটি ‘সর্ব সাধারণের শ্মশান ব্যবহারের জন্য’ লিখে দিয়েছি। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ জায়গাটি কোন কিছু না করতে পারে। গ্রামবাসীদের একটি লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা পুকুরের জায়গাটি বন্দোবস্তের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেছি।”

উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠনের মোহর হিন্দুপাড়া ইউনিটের যুব সংগঠনের সদস্যরা উক্ত কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেন।

happy wheels 2

Comments