অন্নের চেয়ে যেন ভেড়ি বাঁধ সংস্কারের চিন্তাটাই তাদের কাছে বেশি
সাতক্ষীরা থেকে গাজী আল ইমরান, মারুফ হোসেন মিলন ও রামকৃষ্ণ জোয়ারদার
উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙন যেন একটা চিরাচরিত প্রথা। বাংলাদেশে বর্ষা মানে নদী ভাঙন আর নদী ভাঙন মানেই নদী তীরবর্তী মানুষদের চরম দূর্ভোগ। পত্র-পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন নদীর ভাঙন ও ভাঙন কবলিত মানুষদের দুর্দশার যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা সত্যিই হৃদয় বিদায়ক। ‘নদীর এ পাড় ভাঙে, ওপাড় গড়ে এইতো নদীর খেলা।’ এটি দেশের একটি গানের লাইন। আর এই বাস্তবতা উপকূলীয় মানুষদের কাছে যেন কখনই পুরাতন হয় না। প্রতিনিয়ত ঘুরে ঘুরে আসে ভাঙনের এ সর্বনাশা খেলা। নদী তীরের লাখো মানুষ প্রাই বছর ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বশান্ত হয়। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের মিছিল হয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
২০০৯ সালের ১৫ই মে আইলার আগ্রাসনে পড়া শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ খ্যাত ইউনিয়ন গাবুরা পদ্মপুকুর ইউনিয়নের মানুষদের সর্বশান্ত হওয়ার চিত্র যেন এখনো বিগত হয়নি এ এলাকার মানুষদের কাছে। নদী ভাঙনের শিকার জনগোষ্ঠী সব হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ছুটে গিয়েছিল শহরের দিকে। এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করেছিল তারা। অনেকে এক মুঠো অন্নের জন্য বাধ্য হয়েই নানান রকম সমাজ বিরোধী কাজেও লিপ্ত হয়। তাদের কাছে যেন মানবিক হয়ে ওঠে চিরশত্রু। সুতরাং শহরে এ রকম ছিন্নমূল মানুষদের ব্যাপক প্রবেশে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাও বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো অভিশপ্ত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয় শহরের মানুষের কাছে। এই চিত্র কারো কাম্য হতে পারে না।
কিন্তু নদী ভাঙন প্রতিরোধে সেই অতীতের দিনগুলো থেকে আজ অবধি সফল কোনো কর্মসূচি এখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। বাজেটের সিংহভাগ যেন চলে যায় নদী ভাঙনের সাথে। বিভিন্ন মানুষের স্বেচ্ছাচরিতার কারণে নদী ভাঙনের বাস্তব চিত্র সম্বলিত সেই গানটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বরং আরো বেশি করেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুম আসার আগ থেকেই নদী তীরের জনপদগুলোতে এখনো আতংক বিরাজ করে। কারণ, রাক্ষুসী নদীগুলো দয়ামায়াহীনভাবে গ্রাস করে নেয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা স্মারকসহ সমৃদ্ধ জনপদগুলো। মুহূর্তেই নিভিয়ে দেয় নদী তীরবাসীর সুখ-স্বপ্নের। উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাঠি, পূর্ব পাতাখালী, চাউলখোলা, বন্যতোলা এলাকার চিত্র দেখলেই বোঝা যায় এ এলাকার মানুষের দূর্দশার কথা। অন্নের চেয়ে যেন ভেড়িবাঁধ সংস্কারের চিন্তাটাই তাদের কাছে বেশি। ‘খাই দায় পাখি বনের দিকে চাই’ এই প্রবাদের মতই তারা চেয়ে থাকে বাঁধের দিকে।
উপজেলার রমজাননগর ইউয়িনের টেংরাখালির কওমিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন ভেড়িবাঁধের দিকে তাকালে বোঝা যায় এলাকার মানুষগুলো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু তাদের এই নিরব কান্না শোনার মত নেই যেন কেউ। পদ্মপুকুর ও রমজাননগর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নিয়ে এক বা একাধিকবার মানব বন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে স্থানীয় যুব সংগঠন ও এলাকাবাসী। কিন্ত কোন প্রতিকার পায়নি তারা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, টিভি চ্যানেলগুলো এখানকার মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশার কথা তাদের সুন্দর লেখনি এবং উপস্থাপনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হিসাবের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই বিপুলায়তন জমি নদীতে গ্রাস করে নেবার ফলে কতো সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার যে উদ্ভাস্তু হয়ে পড়ে, তার চিত্রটি অত্যন্ত ভয়াবহ। ফসলের জমি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি হারিয়ে ঐসব মানুষগুলোকে যে কি অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্গতির মধ্যে পতিত হতে হয়, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়েনা। আবার, নদী এদিকে ভেঙে অন্যদিকে চর জাগালেও তাতে ভাঙন কবলিত অসহায় মানুষদের উপকারে আসে না। সে চর অধিকাংশ দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এক সময় নদী-শাসনকে অসম্ভব মনে করা হতো। কিন্তু এখন নদীশাসন এবং নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। এখন নদীর ভাঙন রোধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানুষ তা প্রায় একশ বছর আগেই প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে নদী ভাঙনের কবল থেকে গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ রক্ষা এবং বন্যা-নিয়ন্ত্রণের জন্যে দীর্ঘদিন ধরে নদী-শাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
২০০৯ সালের আইলার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা হলেও দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো উল্লেযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্প যেমন হওয়া উচিত বাস্তবভিত্তিক তেমনই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থসম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ এলাকার মানুষের প্রত্যাশা, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী-ভাঙন প্রতিরোধ করতে নদীশাসন ও সংস্কারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।