‘দুধাই নদী শুধু আমাদের দিয়েই যায়’

রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহিদ:::

IMG_20150711_122445

কেউ বলে খোড়া, কেউ বলে খাড়ি, কেউ ডাকে দুধাই নদী। স্থান ভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে খাড়িটি। এলাকাবাসীর মতে, চাপাইনব্বাবগঞ্জের আমনুরা থেকে গোদাগাড়ীর চান্নাই, শুগনা, মুশরা, পাকড়ী, বিল্লি, প্রসাদপাড়া, রিশিকুল, আলোকছত্র, খড়িয়াকান্দি হয়ে বিলদুবইল এসেছে। তানোর উপজেলার বারপিটা, বেলখড়িয়া, বাকশপুর, কাঠালপাড়া দিয়ে পবা উপজেলায় প্রবেশ করে জুয়াখালি নদী নামে পরিচিতি পায়। লদিকান্দা, কুপেরঘাট, বিলনেপালপাড়া হয়ে বাগধানী নামক স্থানে বারনই নদীতে মিলিত হয়েছে।

খরাপ্রবণ এলাকায় খাড়িকে কেন্দ্র করে অনেক জীবের অস্তিত্ব টিকে আছে। খাড়ির দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে মানুষের বসতি। খাওয়ার পানি ছাড়া সকল ধরনের পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে এ খাড়ি। তাই দুই ধারে পানি ব্যবহারের জন্য গড়ে উঠেছে অনেক ঘাট। সারাবছর সেখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ। দুই পাশের বাঁশঝাড়ে বক, কক, পানকড়ি, ছাড়াও বাসা বেঁধেছে অসংখ্য পাখি। এ যেন এক মনোরম পরিবেশ।

খড়িয়াকান্দির আনিসুর রহমান (৫৫) বলেন, “ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে বর্ষা কালে এলাকার রাস্তার যোগাযোগ খারাপ ছিল। তখন খোড়াতে নৌকা পথে পবা উপজেলার নওহাটার রাস্তায় উঠে রাজশাহী যাওয়া যেত। এলাকার ধানসহ বিভিন্ন ফসল বিক্রির জন্য বহন করা হতো ও বাজার থেকে সার ও ভারী মালামাল নৌকাতে করে নিয়ে আসা হতো। কিন্তু খরার সময় পানি কম থাকতো তাই নৌকা চলতো না।

খালের ধারে বসবাস সম্পর্কে জানতে চাইলে রিশিকুলের জুয়েল রানা (৩৫) বলেন, “আমাদের পূর্বের বাড়ি ছিল খড়িয়াকান্দি। প্রতিবছর বন্যায় বাড়ির প্রাচীর ভেঙে যেত। তাই আমার দাদা প্রায় ৫৫ বছর আগে ২ কি. মি. দুরে রিশিকুলে চলে আসেন ও বাাড় তৈরি করে আমরা এখানেই থেকে যাই।”

আলোকছত্র গ্রামের আব্দুল মজিদ খান (৫৪) বলেন, “ত্রিশ বছর আগে ঘনঘন বন্যা হওয়ার কারণে এখানকার জমির দাম কম ছিল। বন্যার কারণে অতীতে ২-৩ জন সম্পদশালী মানুষ জায়গা কিনে আসে পাশের গ্রামে বাড়ি করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আগে থেকেই এখানে আছেন। নব্বই দশকের পর তুলনামূলক বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আর সেই ধরনের বন্যা আর চোখে পড়ে না।’

স্থানীয় মানুষ বলেন, ‘বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে বর্তমানে পানি ধরে রাখার জন্য বিগত পাঁচ বছর আগে খালের মুখে বরেন্দ্র অফিস কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ করায় সারাবছর পানি থাকে। রবি মৌসমে খাড়ির ধারে বেগুন, কফি, টমেটো, রসুন, পিয়াজ, গম, পালং ইত্যাদিতে এ পানি ব্যবহার হয়। খাওয়ার পানি ছাড়া সকল ধরনের পানির চাহিদা পুরণ করেও আসছে। তাই দু’ধারে মানুষ ও গবাদি পশুর গোসলসহ গৃহস্থলে পানি ব্যবহারের জন্য গড়ে উঠেছে অনেক ঘাট।” তিনি আরও বলেন, “সারাবছর সেখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ যেমন- বোয়াল, বাইম, খরি, আইড়, পাতাশি, শোল, টাকি, পুটি, রুই, কাতলা, আইখড়, ময়া, চেংড়ি ইত্যাদি। কিন্তু বাঁধ দেয়ার আগে প্রচুর খরি মাছ পাওয়া যেত কিন্তু বর্তমানে আর মাছই দেখা যায় না। বর্ষার শুরুতে দুই পাশের বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার বক, কক, পানকড়ি পাখি বাসা বাঁধে বর্ষা শেষে আবার চলে যায়। সেই সময় মনোরম এক পরিবেশ তৈরি হয়।”

IMG_20160605_133053

স্থানীয় আজিজুল হক(৫০) বলেন, ‘কোটি টাকা খরচ করলেও সব জায়গায় পাখি থাকে না। কারণ তাদের জন্য লাগে উপযুক্ত পরিবেশ। এ সকল পাখি আমাদের কোন ক্ষতি করে না রবং এলাকার উপকারে আসে।” শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমার বাড়ির সামনের বাঁশ ঝাড়ে পাখির বাস, তাই পাখির ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে। অবসরে তাকিয়ে তাকিয়ে পাখির বিচরণ দেখি। তাদের কাছে গেলেও উড়ে যেতে চায় না, এদের বিচরণ দেখে আমি খুব মজা পাই।”

স্থানীয় যুবক সুজন, জসিম, পলাশ, রাসেল ও শামীম বলেন, “এখানকার পাখি আমাদের ঐতিহ্য তাই পাখিদের নিরাপত্তা আমাদেরই দিতে হবে। আমরা খালের পানিতে সাঁতার কেটে গোসল করি। সারাবছর বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের প্রয়োজনে মাছ সংগ্রহ করে থাকি। তারপরও দলবেঁধে মাছ ধরার মজা তো আছেই। অনেক সময় আবর্জনা ও মলমুত্র খালে প্রবেশ করতে দেখি। একটু সচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে ইচ্ছে করে কেউ করেনা। কারণ সবাই আমরা এ পানি ব্যবহার করি। তাই আমরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়েছি সচেতনতার মাধ্যমে খালের পানিকে দূষণ মুক্ত রাখার।’

চাহিদার তুলনায় আমরা যখন প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু পাই, তখন সেটার প্রতি অনেক সময় অবহেলাও থাকে। তাই সম্মিলিতভাবে সংগঠিত উদ্যোগের মাধ্যমে দর্যোগ ও নষ্ট হওয়ার হাত থেকে স্থানীয় সম্পদ রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব।

happy wheels 2