দৃঢ় পণে জাগো নারী…

ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

৮ মার্চ আন্তজাতিক নারী দিবস। পৃথিবীর অসংখ্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও দিবসটি নানান আঙ্গিকে পালিত হয়ে থাকে। যদিও আমাদের দেশে নারী আন্দোলন ও নারীর অধিকার আদায় অনেক দেরিতে শুরু হয়েছিল। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, আমাদের দেশের নারীদের ভোটাধিকারও ছিলো না। অনেক সময় নারীদের ভোটাধিকার থাকলেও তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হতো না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, কর্মসংস্থানসহ সকল কাজে নারীদের পেছনে ফেলে রাখা হতো। ন্যূনতম ব্যক্তিগত মতামতও দেওয়ার অধিকার নারীদের ছিল না। সামাজিক গোড়ামি, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার আড়ালে নারীকে অনেকটা গৃহবন্দী করে রাখা হতো। নারী ঘরে, বাইরে সকল ক্ষেত্রে হতো বঞ্চিত। এই বন্দীদশা থেকে বারবার নারীরা বের হতে চেয়েছে কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক  ও বৈষম্যের সমাজ ব্যবস্থার বারবার তাকে প্রত্যাখান করা হয়েছে।

আমাদের দেশের নারীরা একটা সময় প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতো না। এক্ষেত্রে ঘুণে ধরা সমাজের কুসংস্কার ও  গোড়াপন্থী ভাবনায় মূলত দায়ি ছিল। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়াই ছিল নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে আমরা অনেকে বেগম রোকেয়ার কথা জানি। তিনিই প্রথম এই সমাজে নারীদের অবরোধবাসিনী থেকে বের হয়ে আসতে পরামর্শ দেন। তিনিই উচ্চ কন্ঠে বলেন নারীদের আর ঘরে আটকে রাখা চলবে না। তিনিই সেই অমর বাণী প্রচার করেন, “জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা”।
বেগম রোকেয়ার সেই অমর গ্রন্থ অবরোধবাসিনী, মতিচুর, সুলতানার স্বপ্নসহ অসংখ্য গ্রন্থে তিনি নারী জাগরণের ডাক দিয়ে গেছেন। তিনি ঘর থেকে আড়াল থেকে নারীদের বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেছেন। বলেছেন নিজের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে সমাজে মাথা উচু করে দাঁড়াতে। বেগম রোকেয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজে হাজারো নারী বৃত্তভাঙার গান গেয়েছেন। সুফিয়া কামাল, মনোরমা মাসিমা, লীলা নাগ, নূরজাহান বেগম, ইলা মিত্র, হেনা দাশ সহ অসংখ্য নারী অগ্রদূতদের কথা আমরা জানি। প্রীতিলতার বীরত্বগাঁথার কথা এখনো ভারত উপমহাদেশের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা এক অমর নাম। যার আত্মহুতির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছিল। এমন হাজারো বীরত্বের ইতিহাস আমরা খুঁজে পাবো এই ভূখন্ডে।

Womens Day 2017
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তার দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে  ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পূণর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। (উইকিপিডিয়া)

বর্তমান পৃথিবীতে নারীর উপর নির্যাতন, বৈষম্য, নিপীড়ন এক নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ঘরে বাইরে সকল ক্ষেত্রে নারীদের কেবলমাত্র নারী হবার কারণে নানান বৈষম্যের শিকার হতে হয়। নারীকে ভোগবাদী পণ্য হিসেবে প্রতিমূহুর্তে প্রচার করা হচ্ছে সকল যোগাযোগীয় ও গণমাধ্যমে। চলচ্চিত্র, নাটক, মডেলিং, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপনসহ সকল প্রচার প্রচারণায় নারীকে উপস্থান করা হচ্ছে খুবই স্থুলভাবে। এর মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কদর্য রূপটিই আমাদের চোখে ভেসে উঠে। নারীর জীবনের বৈচিত্র্যময় কাজ তাকে কেউ ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন না করে বরং তাকে খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করছে। তাই পৃথিবীর সকল জায়গায় দিনদিন নারী নির্যাতন বেড়েই চলছে, বৈষম্য বেড়েই চলছে। এর থেকে মুক্তির পথ কি?

২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, “নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা”। এই প্রতিপাদ্য থেকে আমরা দেখতে পাই বিশ্বকে সমতা ও উন্নয়নের পথে আনতে হলে আজ নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ করতে হবে। নারীকে যেনতেনভাবে ঘরের কোনে বন্দী করে রাখলে আর সম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বিশ্বকে বদলে দিতে চাইলে নারী পুরুষের সমমর্যাদা, সমতা ও সাম্যতা খুবই জরুরি বিষয়। এর সঠিক বাস্তবায়নই পৃথিবীকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের নারী সমাজ দীর্ঘকাল থেকেই নানানভাবে বঞ্চিত। কর্মক্ষেত্র, সংসার, পরিবার, সমাজসহ রাষ্ট্রের সকল জায়গায় নারীরা নিগৃহীত। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। কৃষি, শিল্প, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, নির্মাণসহ সকল ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অন্য আর সকল পেশার কথা বাদ দিলেও একমাত্র কৃষিক্ষেত্রে নারীরা যে অবদান রাখে তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি ব্যবস্থায় নারীরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বৈচিত্র্যময় ফসল, খাদ্যের বৈচিত্র্যসহ প্রাণ ও প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রে নারীরা পালন করে প্রধান ভূমিকা।

এককথায় সকলক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা  আজ আমরা দেখতে পাই। বিমানে পাইলট থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকার, ক্রীড়া থেকে বিজ্ঞান, চাকুরি থেকে সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে নারীদের জয়জয়কার। কিন্তু এর মাঝেও রয়েছে হাজারো বৈষম্যের দেয়াল। এই বৈষম্যের দেয়াল ভাঙতে হলে নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাই নারী দিবসের প্রাক্কালে সকল নারীকে দৃঢ় পণে জেগে উঠবার আহবান জানাই। সকলকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

happy wheels 2

Comments