পানি নিয়ে অন্তহীন সংগ্রাম উপকূলে

::শেখ তানজির আহমেদ, সাতক্ষীরা থেকে

পানি নিয়ে অন্তহীন সংগ্রাম উপকূলেবাড়ির বারান্দায় পুঁতে রাখা মেটে (বড় মাটির পাত্র) থেকে পানি তুলছিলেন গৃহবধূ সন্ধ্যা রানী। এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করা মাত্রই তিনি বললেন, এখানে পানির খুব কষ্ট। এজন্য মেটেতে বৃষ্টির পানি ধরে রেখেছি। মেটেতে রাখা পানি গৃহস্থালীর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করেন তাঁরা। আর খাওয়ার পানি রাখেন কলস, ড্রাম বা অন্য কোন পাত্রে। এটি হলো বর্ষা মৌসুমের চিত্র। আর শুষ্ক মৌসুমে প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন বৃষ্টির পানি থাকে না, পুকুরগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। পানির জন্য চলে হাহাকার। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা। এভাবেই বছরের ১২ মাস পানি নিয়ে চলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় লোনা জনপদের মানুষের সংগ্রাম। কখনও খাওয়ার পানির সংকট, কখনও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য পানি সংকট আবার কখনওবা কৃষিকাজে সেচ সংকটে জর্জরিত তাদের জীবন, পরিবেশ, প্রকৃতি।

 

শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের নট কিশোরী জোয়ারদার জানান, তাঁদের এলাকায় টিউবওয়েলে লোনা পানি ওঠে। শুধু বুড়িগোয়ালিনী নয়, গোটা শ্যামনগর উপজেলার চিত্র একই। এখানকার মানুষ সাধারণত পুকুরের পানি খান। কিন্তু ২০০৯ সালের আইলায় লোনা উঠে যায় শ্যামনগরের মিষ্টি পানির পুকুরগুলোতে। সেই থেকে আজ অবধি খাবার পানির তীব্র সংকট। সংকট রয়েছে কৃষি জমিতে সেচ দেওয়ার পানিরও। বর্ষাকালে দুইতিন মাস বৃষ্টির পানি পাওয়া গেলেও বছরের অন্যান্য সময় লোনায় তিক্ত হয়ে ওঠে জীবন।

 

শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের ইউপি সদস্য সুধাংশু কুমার মিস্ত্রী, নিরঞ্জন জোয়ারদার, গাবুরা গ্রামের আবু মুসা, পদ্মপুকুরের জাকির, রমজাননগরের আক্তারসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় মানুষ পুকুরের পানি পান করে আসছে। পুকুরখালবিলের সাথে তথা উন্মুক্ত জলাশয়ের সাথে এলাকার মানুষের নাড়ীর সম্পর্ক। কিন্তু আইলার পর থেকে সম্পর্কে টানাপোড়েন বাঁধে। লোনায় বিপর্যস্ত হয় এলাকার কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য। সেই থেকেই পানি নিয়ে হাহাকার। এখন বর্ষাকাল, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ব্যস্ত মানুষ। বাড়ির ঘরের চালের পানি বড় বড় ড্রাম, পট অথবা মেটেতে সংরক্ষণ করছে। একই সাথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পুকুর লোনা মুক্ত করার। আর যাদের সুযোগ নেইতাদের দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ অথবা কিনতে হচ্ছে খাওয়ার পানি।

 

তাঁরা বলেন, বাঁধগুলো মজবুত না করলে পানির সমস্যা কখনো সমাধান হবে না। আমরা নিজেদের প্রচেষ্টাই বা সরকারিবেসরকারি সহযোগিতায় পুকুরগুলো সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করলেও কিছুদিন পরপর বাঁধ ভেঙে আবার লোনা উঠে যায়। একই সাথে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে প্রত্যেক পরিবারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

তাঁদের অভিযোগ, এলাকায় যে সরকারি খাল পুকুরগুলো আছে তা সবসময় প্রভাবশালীদের দখলে থাকে। এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হলে মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। 

 

শ্যামনগরে কর্মরত একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব মতে, গোটা শ্যামনগরের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট শুরু হয়। এর জন্য অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষ, নদী ভাঙন আইলাকে দায়ি করে সংস্থাটি।

 

সংস্থাটির হিসেব মতে, শ্যামনগরের প্রায় ৮০ ভাগ গ্রাউন্ড ওয়াটার লবণাক্ত। যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খাওয়ার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত জলাশয়ের উপর নির্ভরশীলতা কমেছে, তবে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্র বেড়েছে। ফলে উন্মুক্ত জলাশয়ে মানুষের প্রবেশগম্যতা না থাকায় সংকট প্রকট হয়েছে।

 

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ৫৭৯৫টি পুকুর ১৩৬টি জলমহাল রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫৩টিতে পিএসএফ থাকলেও ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ রয়েছে ১৮২টি।

 

এছাড়া এক হাজার ৪১২টি গভীর নলকূপ থাকলেও বন্ধ রয়েছে ৮টি। অগভীর নলকূপ রয়েছে ৪২২, বন্ধ রয়েছে ৩টি। যদিও অধিকাংশ নলকূপে লবণ পানি ওঠে। রয়েছে ৩০৪টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগারও।

 

পানি নিয়ে অন্তহীন সংগ্রাম উপকূলে 2স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক অধ্যক্ষ আশেকএলাহী জানান, আইলার পরে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উন্মুক্ত জলাশয়ের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে কমছে। সরকারিবেসরকারিভাবে উপযুক্ত পুকুরগুলো খনন করে পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) করা হচ্ছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতেও মানুষ পানি ধরে রেখে ব্যবহার করছে। লবণাক্ততার কারণে যেমন উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহার কমছে, তেমনি সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায়ও মানুষ উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহার কমিয়েছে। এখন মানুষ ন্যূনতম পিএসএফএর পানি খাবার কাজে ব্যবহার করছে। যদিও দৈনন্দিন গৃহস্থালীর কাজকর্মে এখনো মানুষ নির্ভরশীল উন্মুক্ত জলাশয়ের পানির উপরই।

 

তিনি বলেন, শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট দূরীকরণে পুকুরগুলো সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। এতে একইসাথে খাবার পানির সংকট কমবে, অন্যদিকে মানুষ দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহার করতে পারবে। শ্যামনগরের পানি সমস্যা নিয়ে প্রায় একই রকম মন্তব্য করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সএর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল। তিনি বলেন, উন্মুক্ত জলাশয়ের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমছে। এখন সরকারিবেসরকারিভাবে খাবার পানির সমস্যা সমাধানে এলাকার মানুষের মধ্যে ট্যাংক, ফিল্টার, ড্রাম বিতরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সাথে পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেমের ব্যবহার বেড়েছে। যেসমস্ত এলাকায় টিউবওয়েলে মিষ্টি পানি ওঠে, সেসব জায়গায় পাইপলাইনের মধ্যে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

 

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শ্যামনগরের ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টি ইউনিয়নের কিছু কিছু জায়গায় অনেক চেষ্টার পর ডিপ টিউবওয়েল সফল হয়েছে। এটা আশাজনক হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সফল টিউবওয়েলগুলো থেকে গড়ে ২০টি পরিবার পানি সংগ্রহ করতে পারছে।

 

তিনি বলেন, পদ্মপুকুরের কয়েকটি গ্রামে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। যদিও এই সুযোগ সব ইউনিয়নে নেই।

 

পানি সমস্যা সমাধানে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারেএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্যামনগরের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হলো- আরও প্লান্ট সিটকো প্লান্ট। এর মধ্যে আরও (রিভার্স ওরস্যালাইন) প্লান্ট দ্রুত লবণ পানিকে সুপেয় পানিতে রূপান্তরে সক্ষম এবং সিটকো প্লান্ট আর্সেনিক আয়রন দূরীকরণে বেশ কার্যকরী।

এই প্লান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যয়বহুল হলেও এর মাধ্যমে পানি সংশোধন করে প্রত্যেক ইউনিয়নে সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।

এদিকে, উপজেলায় ৪৫৩টি পিএসএফ থাকলেও ১৮২টি বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিএসএফগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয়দের উপর। মাসে ২০/৩০ টাকা চাঁদা তুলে পিএসএফগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ করার কথা। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পিএসএফ করার কিছুদিন পর স্থানীয়রা সেগুলো রক্ষাণাবেক্ষণে উদাসীন হয়ে পড়ে। ভাবে, সরকার বা এনজিও করেছেতারাই ঠিক করে দিয়ে যাবে।

 

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সায়েদ মোঃ মনজুর আলম জানান, শ্যামনগরের ১৩৬টি জলমহালের মধ্যে মাত্র ২০২৫টি লিজ হয়। বাকিগুলো সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে, সাধারণের নামে ভোগ দখল করে প্রভাবশালীরা।

happy wheels 2

Comments