আমাদের সম্পদেই আমাদের উন্নয়ন

রাজশাহী থেকে  শহিদুল ইসলাম, উপেন রবিদাস ও ব্রজেন্দ্র নাথ

“চারিদিকে কতো কিছু পড়ে আছে, কতো সবুজ, আমাদের কতো সম্পদ, আমাদের কতো লতাপাতা, কত ধরনের উৎসব, পালা পার্বণ আমাদের, কতো সুন্দর সম্পর্ক আমাদের। কিন্তু সেগুলো রক্ষার জন্যে কেউ কথা বলে না। শুধু টাকা আর টাকা। টাকা নিয়েই কথা বলে সবাই। টাকা কি খামু, টাকা কি আমাকে বাঁচাবে। যদি আমার খাবার না থাকে যদি আমার ভূমি না থাকে! যদি আমার সবুজ না থাকে । তাহলে কি দিয়ে বাঁচবো আমারা। টাকা দিয়ে বাঁচা যায় না। টাকা শুধু সম্পর্ক নষ্টই করে না সে আমাদের কষ্টও বাড়িয়ে দেয়।” উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটার ভুগরোইল গ্রামের সুমন বিশ্বাস (৪৫)।
13672159_1122969231098118_702431592_n (1)
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন থেকে মাত্র প্রায় ১১ কি. মি. পশ্চিমে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে ভুগরোইল গ্রামে আদিবাসী  খ্রিস্টান পাড়াটি অবস্থিত। এখানে প্রায় ১৯৮০ সালের দিকে বসতি শুরু হয়। ১৯৮১ সালে সরকারের খাস খতিয়ান থেকে ভূমিহীনদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর থেকেই এখানে বসবাস শুরু হয়। গ্রামের মোড়ল জোহান বিশ্বাস (৬০)বলেন, “আমাদের বাপ দাদারা পাহাড়িয়া আদিবাসী। শুনেছি তাঁরা  ঈশ্বরদীর পূর্ব থেকে এসে নওদা পাড়ায় বসবাস শুরু করে। সরকার ১৯৮১ সালে খাসজমি বন্দোস্ত করে দিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। প্রথম পর্যায়ে ৭টি পরিবার বসবাস শুরু করলেও বর্তমান (জানুয়ারি,২০১৭) বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এখন পবিবারের মোট সংখ্যা ৫০টি।” এই গ্রামে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৫০ জন। মোট পরিবারে মধ্যে ৩২টি পরিবারকে বাড়ি করার জন্যে জমি দেওয়া হযেছে। বাকিরা অন্যের জমিতে বসবাস করেন। পাড়াটির গ্রাম প্রধান (মোড়ল) জোহান বিশ্বাসের মতে, তাদের পূর্ব পুরুষ পাহাড়িয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছিলো,তাঁরা সনাতন ধর্ম পালন করতো, ধীরে ধীরে সবাই ক্যাথলিক খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে।

ফিরে দেখা ভুগরোইল গ্রাম
দিনটি ছিলো ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। চলমান কাজের অংশ হিসেবে সহকর্মী এবং সকলে মিলে সিদ্ধান্ত হয় ভুগরোইল আদিবাসী পাড়াটি পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই পরিদর্শনের মাধ্যমে জনগোষ্টীর সমস্যা ও সম্ভাবনার দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করা হবে। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে জানা যায়, ভুগরোইল গ্রামে ক্যাথলিক মিশন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুই রুম বিশিষ্টি ইটের তৈরি একটি স্কুল ঘর আছে। স্কুলটি ১৯৮১ সালের দিকে শুরু হয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলে। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত চার্চ এর মাধ্যমে স্কুলটি পরিচালিত হতো। স্থানীয় কয়েকজন লোক সেখানে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে আর্থিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে পাড়ার স্কুলটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রায় ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থীর লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। এখানে ৫ম শেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শেখানো হতো। পাড়াটিতে মানুষগুলোর যৌথ উদ্যোগ এবং সচেনতার অভাবে দিনে দিনে শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। তাদের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়;

২০১৭ সালে নিজস্ব উদ্যোগে কিছু সম্ভাবনার কথা
গ্রামটির বিভিন্ন পর্যায়ের লোকের সাথে আলোচনা, মতবিনিময় এবং পর্যবেক্ষণে জানা যায়, গ্রামটিতে বেশিরভাগ মানুষ জমিতে দিনমজুরের কাজ করে। পৌরসভা হলেও তারা নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিজেরা যৌথ উদ্যোগ নিয়ে কখনো পেশার পরিবর্তনেরও কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কারণ পাশেই একটি সিটি কর্পোরেশন থাকতেও সেখানে নানামূখী কর্মসংস্থানের সুযোগ না নেওয়ার ফলে অভাব এবং দারিদ্রতা লেগেই থাকে। এছাড়া উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযুক্ত উদ্যোগ, দক্ষতার উন্নয়ন ও মানসিকতার পরিবর্তন সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম না নেওয়ায়  ধীরে ধীরে এসব মানুষের আত্মবিশ্বাস ও শক্তিসামর্থ্য প্রয়োগ করার কোন প্লাটফরম পাননি। নিজের যে শক্তি সামর্থ আছে, আছে সম্পদ, তা কাজে লাগিয়ে নিজের উন্নয়ন যে নিজেই করা সম্ভব সে বিষয়গুলো আলোচনা এবং পরামর্শের অভাবে তারা নিজেদের সবসময় দরিদ্র এবং অসহায় ভাবতেন।
13713419_1122969247764783_1407442441_n
পর্যবেক্ষণে জানা যায়, গ্রামের ৩কিঃমিঃ এর মধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি এবং একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, কিন্তু অবিভাবকগণ সেখানে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। অনেকে ছোটছেলে মেয়েদের দ্বারা গরু-ছাগলের খাদ্য সংস্থান এবং পারিবারিক কাজও করান। এভাবে দিনে দিনে শিশু শ্রম বাড়তে থাকে।

নিজস্ব সম্পদ ও শক্তি কাজে লাগানো
বারসিক বিভিন্ন সময় গ্রামের মানুষগুলোর সাথে আগ্রহীদের নিয়ে মতবিনিময়, আলোচনা, সংলাপ এর আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর ফলে স্থানীয়দের মধ্যে নিজেদের সম্পদ এবং শক্তির দিকগুলো তারা আরো বুঝতে পেরে নিজেরাই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করেন। গ্রামের পুকুরটিতে যৌথভাবে মাছ চাষ এবং গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ছাত্র অভিভাবকদের নিয়ে পরামর্শ করার ফলে বর্তমান গ্রামটির সকল শিশুরা স্কুলে যায়। গ্রামের সামাজিক পুকুরটি এখন আর অযথা পড়ে থাকে না। সেখানে এখন যৌথভাবে মাছ চাষ হয়। সামাজিক পুকুরে যৌথভাবে মাছ চাষ এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৬ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রামের সুতিহার দিঘির যৌথভাবে মাছ চাষের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেন এই গ্রামের মানুষ।

অন্যদিকে একই সাথে নিজেদের উদ্যোগে কিভাবে শিশুদের স্কুলগ্রামী এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে গ্রামের নির্বাচিত কয়েকজন মানুষ মানিকগঞ্জে প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতা অর্জনে বারসিক তাদের সহযোগিতা করে। এই  অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা ধীরে ধীরে উন্নয়ন করছেন নিজের এবং নিজের সমাজের। গ্রামের স্কুলটিতে শিশুরা এখন প্রতি সপ্তাহে দু’দিন নিজের লেখাপড়াসহ পরিবেশ, প্রতিবেশ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মননশীলতার চর্চার বিষয়গুলো আলোচনা করে থাকেন। ভুগরোইলনারীরা মুঠি সমিতির মাধ্যমে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আনার চেষ্টা করছেন। প্রতি সপ্তাহে নিজেরাই মুঠি চাল জমা করেন। সাপ্তাহিক সঞ্চয় করেন। নারী ও পুরুষ মিলে গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন তৈরি করে সকলের পরামর্শে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খরার সময় নিজেদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সুরক্ষায় গড় আলূসহ নানা দূর্যোগকালীন খাবার উৎপাদন ও ব্যবহার করছেন। দিনে দিনে তা প্রসারও ঘটছে। ছোট হলেও নিজেদের সম্পদ এবং শক্তি ব্যবহার করে তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই প্রসঙ্গে গ্রামটির সংগ্রামী নারী আদরী মিনজ বলেন, “নানা সমস্যার মধ্যেও আমরা একত্রিত থাকার চেষ্টা করছি। আশা করি একদিন আমরা নিজের শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করেই নিজেদের উন্নয়নে এগিয়ে যাবো।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের সম্পদেই আমাদের উন্নয়ন করি।”

উন্নয়নকে আমরা অনেক সময় শুধু অর্থ দিয়েই বিচার করি। আমরা মনে করি, উন্নয়ন মাপনিতে সমাজ, দেশের সম্পদ, বৈচিত্র্যকেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ একটি সমাজের বা অঞ্চলের মানুষ তখনই বেশি নিরাপদ এবং স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব যখন তার নিজস্ব সম্পদ সুরক্ষা এবং সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে পারে।  গ্রামীণ মানুষের যে শক্তি এবং সম্পদ আছে তা সুস্থ এবং সমন্বিতভাবে ব্যবহার করলে একই সাথে যেমন পরিবেশ প্রতিবেশ সুরক্ষা হয় তেমনি স্থানীয় প্রান্তিক মানুষগুলোর সবকিছুর স্থায়িত্ব বাড়ে।

happy wheels 2

Comments