একটি খাসি পুঞ্জি (গ্রাম) এবং জীবিকা ও পরিবেশ সুরক্ষায় খাসিদের সংগ্রাম

সিলভানুস লামিন

প্রেক্ষাপট: খাসি জনগোষ্ঠী
বিশ্বের প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী স্থায়িত্বশীল, কার্বন নিরপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে কার্বন-নেতিবাচক জীবনযাত্রা পরিচালনা করে; যার কারণে তারা হাজার হাজার বছর টিকে আছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে উল্লে¬খ্যযোগ্য অবদান রাখতে পারছেন। সুতরাং যে জাতির জীবন-জীবিকায় কম কার্বন নির্গমন হয় নিঃসন্দেহে সেই জাতি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে কম ভূমিকা রাখে কিংবা রাখেই না। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু নজিরবিহীনভাবে বিশ্বের মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। আইপিসিসি’র প্রতিবেদন অনুয়ায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুরো পৃথিবী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উষ্ণতর হচ্ছে। লাগামগীনভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হওয়ার কারণে এই উষ্ণায়নের মূল কারণ। সুষ্ঠু ও সঠিক প্রশমন বা মোকাবিলার কৌশল না থাকায় আইপিসিসি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, এই শতাব্দীর শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ থেকে ৪.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে বৃদ্ধি পাবে; যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার পর্যন্তবৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসীর মধ্যে খাসি অন্যতম। খাসিদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, জীবনপ্রণালী প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। প্রকৃতি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। একটি খাসি শিশু জন্মের পর থেকে প্রকৃতির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। কারণ এই প্রকৃতির কাছেই সে তার প্রয়োজনীয় সবকিছুই পেয়ে থাকে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি, জ্বালানি, আসবাবপত্র, ঔষধ, খাবার-দাবার সবকিছুই তারা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে থাকে। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলায় আনুমানিক ২৫ হাজারের মতো খাসি জনসংখ্যা অনেকদিন থেকে বসবাস করে আসছেন। বংশপরম্পরায় তারা পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ করে আসছে প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করে। বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো খাসিরাও নানাভাবে নির্যাতিত, শোষিত ও হয়রানির শিকার। জীবনের প্রতিটি পদে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যা ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করেই তারা জীবন পথে এগিয়ে চলে। একটি খাসিয়া শিশু জন্মের পর থেকে নানা বঞ্চনা, শোষণ, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। নিজ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়ার কৌশল তাকে শিখতে হয় সে সময় থেকেই। এই সংগ্রামময় জীবনে প্রকৃতি তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। তাইতো পাহাড়ের বুকে সে আশ্রয় নিয়ে নতুন স্বপ্ন রচনা করতে প্রয়াসী হয়, পাহাড়-গাছপালা, লতাপাতা, পশুপাখি, ঝরণা, ছড়া থেকে শিখে নেয় তার জীবন ও জীবিকাকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল।

খাসি সম্প্রদায়কে জমির জন্য, ভিটে মাটির জন্য, পানের জুমের জমির জন্য এবং নিজ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য আজীবন সংগ্রাম ও লড়াই করতে হয়েছে। বংশপরম্পরায় একই জমিতে চাষাবাদ করার পর কোনও একসময় দেখা যায় যে, তাদের সে জমি ছেড়ে দিতে হয় কিংবা জমিটি জোরপূর্বক দখল ও কেড়ে নেওয়া হয়। জীবনের ঠিকানা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তায় তাদেরকে নতুন বাড়ি, নতুন ঠিকানা ও পানজুমের জমির সন্ধান করতে হয়। খাস জমি, বনবিভাগের এবং চা বাগানের জমির লিজ নিয়ে এরা বংশপরম্পরায় এভাবে জীবন পরিচালনা করে আসছেন। খাসিরা পাহাড় পোড়ে না, গাছ কাটে না, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে না! পান চাষের জন্য তারা পতিত ও অব্যবহৃত নেড়া পাহাড়ে গাছ রোপণ করে, জৈব সার ব্যবহার করে এবং ফসলে কোন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার না করে উৎপাদন করে। সারা বিশ্বের মানুষ যখন কোন না কোনভাবে প্রাণবৈচিত্র্য হরণপ্রক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সেখানে খাসি জনগোষ্ঠী পাহাড়-বন-জঙ্গলনির্ভর জীবন পদ্ধতি পরিচালনা করে নিরবে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে চলেছেন। এই লেখাটি মূলত খাসিদের জীবন-জীবিকা পরিচালনা, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত ও চর্চিত বিভিন্ন অভিযোজন পদ্ধতিসহ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলভীবাজার জেলার অর্ন্তগত শ্রীমঙ্গল উপজেলার নিরালা পুঞ্জিকে নমুুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। খাসিদের সামাজিক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য এই গ্রামকে বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে গ্রামটিতে জনসংখ্যার আধিক্য এবং সেখানে খাসিদের দীর্ঘদিনের বসবাস। এই গ্রামের খাসিদের সার্বিক জীবনযাত্রার সাথে অন্যান্য খাসি গ্রামের সাথে ব্যতিক্রম কিছু পার্থক্য থাকলেও মৌলিক কোন পার্থক্য নেই; কারণ বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ৯৯% খাসিই প্রকৃতিনির্ভর পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।

উচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তা তারপরও খাসি গ্রামে যাত্রা
মৌলভীবাজার জেলার অর্ন্তগত শ্রীমঙ্গল উপজেলার পূর্বদিকে খাসি পুঞ্জি নিরালা অবস্থিত। শ্রীমঙ্গল থেকে পিক-আপ কিংবা জীপ গাড়িতে করে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে খাসিয়া পুঞ্জি নিরালাতে পৌঁছুতে। এই গ্রামে যাওয়ার জন্য একমাত্র যানবাহন হচ্ছে এই জীপ বা পিক আপ গাড়িই। অন্যান্য যানবাহন তথা বাস, রিক্সা, ট্যাক্সি, সিএনজিতে করে এই গ্রামে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ যাওয়ার পথে উচু-নীচু কাচা রাস্তা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ এইসব যানবাহনের চলাচলের উপযোগী নয়। এই গ্রামে প্রতিদিন একটি জীপ গাড়িতে করে খাসিরা শ্রীমঙ্গল শহরে আসে। সকাল ১০টার দিকে এটি নিরলা থেকে ছাড়া হয় এবং দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে শ্রীমঙ্গল থেকে নিরলা পুঞ্জির উদ্দেশ্যে ছাড়া হয়। এই সময়ে মধ্যে না আসলে নিরলা পুঞ্জিতে যাওয়ার অন্য কোন যানবাহন পাওয়া যায় না। বিকল্প হিসেবে তখন ভাড়া করে সেই গ্রামে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গল থেকে ওই গ্রামে ভাড়া করে গেলে আনুমানিক ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা লাগে; যা দূরত্বের তুলনায় অনেক বেশি।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

খাসি গ্রামে গেলে যে দৃশ্যটা সর্বপ্রথমে চোখে পড়বে তা হলো সারি সারি গাছপালার গায়ে আপন মনে আকড়ে ধরে থাকা লতা জাতীয় পান এবং চারদিক ঘন ঝোপঝাড়। এছাড়া খাসিদের জীবনযাত্রা, জীবিকা অবলম্বন পদ্ধতি, প্রকৃতির সাথে নিবিড় যোগাযোগ, প্রকৃতি নির্ভর চাষাবাদ পদ্ধতিসহ আরও অনেক অনন্য দৃশ্য সহজেই চোখে পড়বে, যা যে কাউকে বিমোহিত করে তুলবে। নিরালা পুঞ্জিটি সমতল থেকে প্রায় দেড়শ’ থেকে দুইশ’ ফুট উচুতে অবস্থিত। জানা যায়, খাসিদের গ্রামগুলোর মধ্যে এই পুঞ্জিটিই সবচে’ উচুতে অবস্থিত। গ্রামটিতে খাসিরা দীর্ঘদিন ধরে পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অবশ্য বর্তমানে পানের পাশাপাশি কেউ কেউ সুপারি, লেবু, আনারস আবাদ করে সংসারের জন্য অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করে। নিরালা পুঞ্জিতে প্রায় একশ’ ৮০ খাসি পরিবার এবং গারো পরিবার রয়েছে। এই গ্রামের লোকসংখ্যা আনুমানিক ৮০০’র অধিক। গ্রামে তিনটি গির্জা (ক্যাথলিক, প্রেসবিটারিয়ান ও চার্চ অব গড ধর্মাবলম্বীদের), একটি মিশনারিজ পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি মুদির দোকান এবং একটি কবরস্থান রয়েছে। এই গ্রামে কারিতাস, ব্র্যাক, আশাসহ আরও কয়েকটি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কারিতাস ক্ষুদ্র ঋণ ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মসূচি ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পান উৎপাদন: পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া, নেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
খাসিদের কৃষি হচ্ছে প্রকৃতিনির্ভর। এই কৃষি চর্চার ক্ষেত্রে খাসিরা তাদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান বা লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেন। মূলত অর্থকরী ফসল চাষই খাসিদের কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে অন্য অর্থকরী ফসলের মধ্যে পান অন্যতম। খাসিদের উৎপাদিত পান দেশে ছাড়া বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ খাসি পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এই পান চাষ প্রক্রিয়ায় জমি, শ্রম, পুঁজি এবং সংগঠনের দরকার পড়ে। পান চাষ প্রক্রিয়ায় খাসিরা কখনও রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে না। বরং তাদের লোকায়ত জ্ঞান ও চর্চার ওপর ভিত্তি করেই এই চাষ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে থাকে। খাসিদের কৃষি কেবলমাত্র পানচাষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার পেছনে কতকগুলো কারণ রয়েছে। ভৌগলিক অবস্থান, পানচাষে খাসিদের বংশপরম্পরায় জ্ঞান, অধিক লাভজনক এবং বাহ্যিক চাপ-এর কারণে তাদের কৃষিব্যবস্থা কেবলমাত্র পানচাষের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশে খাসিরা উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য বংশপরম্পরায় পানচাষ করে আসছেন। নিরালাপুুঞ্জির খাসিদের প্রায় সবাই পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পানচাষে যেহেতু তারা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে না; বনজঙ্গল পোড়ে না, গাছ নিধন করে না, পাহাড় কাটে না সেহেতু খাসিরা যখন কোন ভৌগলিক এলাকায় বসতি স্থাপন করতে আসে তারা শুরু থেকেই প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। তাই তো নিরাল পুঞ্জির খাসিদের পান জুমে অসংখ্য দেশী ও নাম না জানা গাছপালা, বিভিন্ন পশু-পাখি, হরেক রকমের লতা জাতীয় উদ্ভিদ ইত্যাদি দেখা যায়। পুঞ্জির খাসিরা জানান, সন্ধ্যা হওয়ার পর বন মোরগের ডাক শোনা যায়। এছাড়া খাসিদের জুম এলাকায় যাওয়ার সময় অসংখ্য প্রজাতির পাখির কলকাকলি শোনা যায় এখনও। বেঁচে থাকার তাগিদেই খাসিরা প্রকৃতিঘনিষ্ঠ এই কৃষিব্যবস্থা পরিচালনা করেছে। তাই একজন খাসি মানুষ জন্মের পর থেকে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে তার হাতে খড়ি হয়। কারণ জন্মের পর সে যে কৃষিব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয় সেই কৃষিব্যবস্থাই তাকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে প্রকৃতির কোন ক্ষতি না করে ফসল উৎপাদন করা যায়; জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে প্রকৃতির সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার করতে হয়।

অনাবাদী ও পরিত্যক্ত পাহাড়গুলোতে গাছ রোপণ ও লালন-পালনের মাধ্যমে খাসিদের পান চাষ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারা এসব পাহাড়-টিলা আবাদযোগ্য করে তোলে। নিরালা পুঞ্জির খাসিরা প্রায় ৪০ বছর যাবৎ এ গ্রামে পানের পাশাপাশি সুপারি, লেবু আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুঞ্জিবাসীরা জানান, প্রথমে যখন তারা এই গ্রামে আসেন তখন চারপাশ কেবল ঝোপঝাড় ছিলো। কদাচিৎ দু’একটি গাছ চোখে পড়তো। তারা সে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে, গাছ রোপণ করে সেখানে পান চাষ শুরু করে। বর্তমানে এই গ্রামের খাসিদের পানজুমে আনুমানিক কয়েক লাখ গাছ রয়েছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আমরা মনে করি, প্রাকৃতিক বনায়নের এই দায়িত্বটি খাসিদের ওপর ছেড়ে দিলে তারা সহজে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবে। এতে অর্থের খরচও সাশ্রয় হবে; যেহেতু খাসিদের জীবন-জীবিকার তাগিদেই গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে কেবল দরকার শুধুমাত্র সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও জমির মালিকানা নিশ্চিতকরণ। তবে দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অন্যান্য কৃষিব্যবস্থায় ভর্তুকিসহ বিভিন্ন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও খাসিদের পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চায় সরকারি ও বেসরকারি কোনও পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা নেই। প্রকৃতি নির্ভর পান চাষে কোনসময় খরা হলে খাসিদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। অথচ অর্থকরী ফসল পান চাষের ক্ষেত্রে সেচব্যবস্থাসহ অন্যান্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে আর্থিকভাবে খাসিরা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সরকার যেমন লাভবান হবে তেমনি পরিবেশ রক্ষা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণও নিশ্চিত হতো।

এখানে খাসিদের পরিবেশবান্ধব ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক কৃষিব্যবস্থার ধারবাহিক ধাপগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া প্রয়োজন যাতে করে কেন তাদের কৃষিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে এই লেখায় আখ্যায়িত করা হয়েছে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। নিম্নে নিরালা পুঞ্জির খাসিরা (পক্ষান্তরে সব খাসিদের) পান চাষাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেছেন তা নিয়ে আলোচনা করা হলো-

জমি নির্বাচন
পান চাষের জন্য জমি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত হেডম্যান বা মন্ত্রী সরকারি খাস জমি স্থায় বন্দোবস্ত, লিজ, বনবিভাগের জমি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন অথবা চা বাগানের ভূমি লীজ নিয়ে সাধারণ খাসিদেরকে দিয়ে চুক্তিভিত্তিক পানচাষ করান অতীতে খাসিরা মন্ত্রী বা হেডম্যানের সাথে চূড়ান্ত কথাবার্তা বলার পর লীজকৃত জমি পরিদর্শন করেন এবং যে যার মতো করে জমি নির্বাচন করেন। পান চাষের জন্য দো-আউশ মাটি উত্তম। তাই খাসিরা জমি নির্বাচনের সময় দো-আশ মাটিযুক্ত জমিটিকে বেশি প্রাধান্য দেন। সাধারণত পান চাষের জন্য জমি বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় একর বা শতাংশ হিসেবে করা হয় না; বরং জমিতে থাকা গাছ সংখ্যার ভিত্তিতে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেহেতু পান চাষ প্রক্রিয়ায় মাটির সাথে গাছ অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া সেহেতু বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় এই রীতি মেনে চলা হয়। জমি নির্বাচন যেকোন সময় হতে পারে; সেটি শীতকাল কিংবা বর্ষাকাল। তবে তুলনামূলকভাবে শীতকালে নতুন জুমের জমি নির্বাচন ভালো। কারণ এ সময় কম ঝোপ থাকে এবং বর্ষাকাল তথা চাষাবাদের মৌসুম আসার আগেই জমির ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করা যায় এবং এতে খরচও কম পড়ে।

ঝোপঝাড় পরিষ্কার
জমি নির্বাচন প্রক্রিয়ার পর খাসিরা পান আবাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কারের উদ্যোগ নেন। ঝোপ পরিষ্কারের বেলায় কিন্তু খাসিরা কখনও আগুন ব্যবহার করেন না। তাদের মতে, আগুন দিয়ে ঝোপ-ঝাড় পোড়ালে গাছপালা মারা যাবে এবং মাটিতে ও মাটির ভেতরে থাকা ছোট ছোট গাছসহ অন্যান্য প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হবে; মাটি শক্ত হবে। এ ধারণা পোষণের কারণে খাসিদের পান চাষকে ‘জুম’ বলে আখ্যায়িত করা হলেও তারা কখনও জ্বালানো-পোড়ানোর কাজ করে না। ঝোপ-পরিষ্কারের ক্ষেত্রে তারা দা, নিড়ানি ব্যবহার করেন। তবে ভার্জিন ল্যান্ড হলে ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার কষ্টসাধ্য কাজ। প্রাথমিকভাবে ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জমিতে গাছের পরিমাণ কত তা জানা এবং সেই মোতাবেক পানের চারা বরাদ্দ। কোনক্ষেত্রে নির্বাচিত জমিতে গাছের সংখ্যা অধিকমাত্রায় কম হলে খাসিরা সেখানে নতুন গাছ রোপণের উদ্যোগ নেন।

পান চারা রোপণ
প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত জমিটিতে কয়টা গাছ আছে তা জানার পর সে মোতাবেক পানের চারা বরাদ্দ করা হয়। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে নতুন ও পুরাতন জমিতে খাসিরা পানের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণের ক্ষেত্রে খাসিরা গাছের গুঁড়ির কাছে মাটিতে একহাত থেকে দেড়হাত গর্ত খুঁড়ে এবং সেই গর্তে পানের চারাটি রোপণ করে। এমনভাবে চারা রোপণ করা হয় যাতে চারার অর্ধেক মাটির নীচে এবং বাকিটি  মাটির ওপর থাকে যাতে রোপিত চারা পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায়। চারা রোপণের পর খাসিরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। চারা রোপণের দিন কিংবা রোপণের পরের দিনে বৃষ্টিপাত হলে নতুন রোপিত চারাটির জন্য খুব ভালো হয়; এতে চারাটি দ্রুত মাটিতে শেকড় ছড়াতে পারে। তবে রোপণের দুই কিংবা তিনদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলে চারা মারা যায়।

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

আগাছা পরিষ্কার
এখানে আগাছা বলতে অবাঞ্চিত ঝোপ-ঝাড় বা বনকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলো পান গাছের জন্য ক্ষতিকর। খাসিরা আগাছা পরিষ্কারের ক্ষেত্রে সব সময় মাটি যাতে অতিরিক্ত আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে খেয়াল করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, মাটির ভেতরে অসংখ্য অণুজীব রয়েছে যা মাটিকে উর্বর করে। সাধারণত চারা রোপণের পর যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি হলে সেই চারা থেকে শেকড় গজাতে এবং চারা থেকে পান লতা হতে দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। নতুন রোপিত চারা থেকে লতা বের হলে এবং সেই লতা গাছের গুড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলে খাসিরা আগাছা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেন। আগাছ পরিষ্কার না করলে আগাছার কারণে নতুন চারাটি মারা যেতে পারে। এছাড়া নতুন গজে ওঠা চারার লতা যাতে আলো-বাতাস লাভ করে দ্রুত বৃদ্ধি হয় সেজন্য আগাছা পরিষ্কার খুব দরকার পড়ে। অন্যদিকে পরিষ্কারকৃত আগাছার স্তুপ নতুন রোপিত ও গজে ওঠা চারার গুঁড়িতে রাখা হলে সেগুলো পচে সারের কাজ করে। সাধারণত ভালো উৎপাদনের জন্য খাসিরা বছরে দু’বার আগাছা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। তবে ভার্জিন জমির ক্ষেত্রে তিনবারও আগাছা পরিষ্কার করা হয়ে থাকে। আগাছা পরিষ্কারের ক্ষেত্রে খাসিরা নিরানী বা দা ব্যবহার করে থাকেন। কখনও আগাছানাশক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে না। এই প্রসঙ্গে নিরালা পুঞ্জির ভারত এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগাছানাশক ব্যবহার করা হলে মাটির ক্ষতি হতে পারে। মাটিতে থাকা কেচো এবং অন্যান্য অণুজীব যা মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে সেগুলো মারা যেতে পারে। তাই বেশি শ্রম ও খরচ হলেও আমি আমার পানজুমের আগাছা হাতেই পরিষ্কার করি’।

গাছের ডালাপাল কলম
নতুন রোপিত চারা পর্যাপ্ত বৃষ্টি পাওয়ার পর মাটিতে শেকর ছড়ালে ওই চারাগুলোতে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাস এবং মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে সেজন্য গাছের অবাঞ্চিত ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়; তবে কোনভাবে পুরো গাছ কাটা হয় না। গাছের অবাঞ্চিত ডালপালা কেটে ফেলার পর নতুন রোপিত চারাটি পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায় এবং কেটে ফেলা ডালপালাগুলো জড়ো করে নতুন রোপিত চারাটির গুঁড়িতে রাখা হয় যাতে সেগুলো পচে গিয়ে সারের কাজ করে এবং চারাটি সেখান থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে গাছপালার ডালপালা ছেঁটে ফেলার মাধ্যমে গাছের জন্য সুবিধা হয়। এতে করে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে এবং দীর্ঘকায় হয়। এ গাছ থেকে পর্যাপ্ত কাঠও পাওয়া যায়। নতুন জমির ক্ষেত্রে গাছের ডালাপালা বেশি করে কেটে ফেলা হয় যাতে মাটি পর্যাপ্ত সুর্যের আলো পায়। খাসিদের মতে, প্রাথমিকভাবে ভার্জিন জমিটি যদি পর্যাপ্ত সূর্যের আলো লাভ করে তাহলে এর পুষ্টি উপাদানগুলো ‘ক্রিয়া’ করতে শুরু করে এবং এতে করে নতুন রোপিত চারাটির জন্য ভালো হয়। চারাটি দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করে। তাই দেখা যায় ভার্জিন জমিতে পান চাষ হলে সে জমিতে উৎপাদন বেশি হয়। অন্যদিকে পুরাতন জমি হলে গাছপালার ডালপালা হালকাভাবে কাটা হয়; যাতে অতিরিক্ত সূর্যের আলোতে পান নষ্ট এবং জুমের মাটি শক্ত হয়ে না যায়।

জুম থেকে পান সংগ্রহ
সাধারণত চারা রোপণের এক বছরের মাথায় সেই জমিতে কমবেশি পান উত্তোলন করা যায়। তবে জমির বয়স তিন থেকে চার বছর হওয়ার পর সেই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পান উত্তোলন করা সম্ভব হয়। এভাবে জমির বয়স দশ বছর পর্যন্ত হলে সে জমিতে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। তবে জমির পান যদি রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে সেই জমিতে আস্তে আস্তে পান উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। বিশেষ করে জমির বয়স তিন-চার বছর হয়েগেলে ‘উট্রাম’ নামক এক ভাইরাস রোগের আক্রমণের ঝুঁকি থাকে। উট্রাম আক্রমণ না করলেও পান জুমের বয়স দশ থেকে ১৫ বছর পুরাতন হলে সেই জমিতে পান উৎপাদনের পরিমাণও কমে যায় তবে এক্ষেত্রে মাটির গঠন, পুষ্টি উপাদান এবং পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে। মাটির গঠন ভালো ও পুষ্টি উপাদান বেশি হলে সে জমিতে অনেক বছর পর্যন্ত পান তোলা যায়। আবার মাটির গঠন ও পুষ্টি উপাদান এবং পরিচর্যা সঠিকভাবে না করলে সে জমি থেকে ৮ থেকে ১০- বছর পর আকস্মিকভাবে উৎপাদন কমে যায়। একটি পান জুম থেকে বছরে চার থেকে পাঁচবার পান উত্তোলন করা যায়। বছর শেষে খাসিরা পান লতার সব পাতা তুলে ফেলে। এটাকে ‘হাত‘টেখিয়া’ বা ‘লংখং’ বলা হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পানের ‘লংখং’ করা হয়। ‘লংখং’ করার এক এক থেকে দুই মাস পার হলে এবং বৃষ্টি পর্যাপ্ত হলে নতুন পাতা তোলা হয়। এটাকে ‘হাতলবর’ বলা হয়। এভাবে পান তোলার প্রত্যেকটি সময়ের নাম রয়েছে-যথা ‘হাত বেশিয়া’, ‘খ্লহ লেমেনটেরি’, ‘হাত টেখিয়া কেন্ডিট’ ইত্যাদি।

অন্যদিকে পান জুমের বয়স তিন থেকে চার বছর হওয়ার পর সেই জুমের পান থেকে নতুন চারা তৈরি করা যায়। সাধারণত খাসিরা এই প্রক্রিয়াকে ‘বুট টাং’ বা চারা কাটা বলেন। গাছের গায়ে বেয়ে যাওয়া পানের লতাটি মাঝখান থেকে কিংবা তার দৈর্ঘ্যরে এক তৃতীয়াংশ বা অধিক কেটে ফেলা হয়। কাটা অংশ থেকে রোপণের জন্য চারা তৈরি করা হয়। এছাড়া একটি গাছে পানের অধিক লতা বেয়ে উঠে। তাই চারা কাটার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সতেজ, সুষ্ঠু-সবল দু’একটি লতাকে বেছে নিয়ে বাকিগুলো সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হয়। এবং নির্বাচিত (ক্ষেত্রবিশেষ অধিক) লতাগুলো মাঝখান থেকে কেটে ফেলা হয়। পানের জমিতে যদি উট্রাম ও অন্যান্য রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয় তাহলে প্রতি দুইবছর অন্তর অন্তর পানের চারা কাটা হয়। পানের চারা কাটা হয় কেবলমাত্র চারা পাওয়ার জন্য নয়; বরং পানের লতা কাটা হলে সেই লতা শক্তিশালী হয় এবং কাটা অংশ থেকে নতুন কচি লতা গজে উঠে বলে পান গাছটি সবল ও সতেজ হয়। তাই কেবল চারা তৈরির জন্য নয়; পানের গাছকে সতেজ-সবল ও সজীব করে তোলার জন্য খাসিরা ‘বুট টাং’ করে থাকেন। একটি পানজুম থেকে ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত পান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এরপর পানের জুমকে দুই থেকে তিনবছর অনাবাদী রাখা হয়। খাসিরা বিশ্বাস করেন পানের জুমকে দুই তিন বছর অনাবাদী রাখলে সেটি আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে; উর্বর হয়। এভাবে কোন জমি তারা একনাগারে পান আবাদ করেন না; বরং একবার পান চাষের পর সে জমি কিছু বছরের জন্য পরিত্যক্ত রাখেন। তবে বর্তমানে জায়গা-জমি কমে যাওয়ার কারণে অনেক খাসিরা পানের জুমকে কিছু বছরের জন্য পরিত্যক্ত রাখার বিলাসিতা দেখাতে পারেন না।
এভাবে খাসিরা তাদের লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পান চাষ করেন। উপরোক্ত চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় এমন কোন নেতিবাচক দিক পাওয়া যাবে না, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য করা যায়। তবে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবান্ধব জীবন-জীবিকা পরিচালনা করলেও খাসিদের বর্তমান জীবন-জীবিকায় বিপন্নতা দেখা দিয়েছে। খাসিদের কৃষিব্যবস্থায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, জমি হারানো এবং জমির মালিকানা লাভে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আজ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণকারী এই জনগোষ্ঠীকে সন্মূখীন হতে হয়েছে কঠিন বাস্তবতার।

জলবায়ু পরিবর্তন: ব্যাহত পান উৎপাদন; তারপরও অভিযোজন
চলার প্রতিটি পথে এই খাসিদেরকে নানা হুমকি ও ভয়ভীতির সন্মুখীন হতে হয়। জোর ও শক্তি প্রয়োগ করে জমি হরণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ, সংস্কৃতির আগ্রাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হয় বলে পেশাগত বা অর্থনৈতিক জীবনের এই পরিবর্তনশীলতার চাপ সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অধিকারবঞ্চিত হওয়ায় স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে তাদের অভিগম্যতা নেই। নিম্নে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যা খাসিদের কৃষিব্যবস্থা কীভাবে বিপন্ন হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রকৃতিনির্ভর খাসিদের কৃষিও আজ বিপন্ন। পান চাষের জন্য বৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বৃষ্টি পানির প্রাপ্যতা কম হওয়ার কারণে বিগত পাঁচ বছরে খাসিদের পান চাষ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া পান চাষে যেহেতু রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না বরং জৈব সার ব্যবহার করা হয়। সেহেতু বৃষ্টি পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার কারণে জৈব সার তৈরিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানের উট্রাম রোগ ছাড়া গুড়া পচা রোগ, কলেরা, রাঙা রোগসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন খরা, শিলাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ, ঝড় খাসিদের জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে। সামগ্রিকভাবে এই পরিবর্তনের কারণে খাসিদের পান উৎপাদন বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় কমে গেছে। নিরালার খাসিরা জানান যে, পান চাষ প্রক্রিয়ায় নানান পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বিগত ৫ বছর ধরে এই গ্রামসহ অন্যান্য খাসিদের জীবন-জীবিকায় হঠাৎ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়; প্রকৃতিনির্ভর পানচাষে আমূল এক পরিবর্তন দেখা দেয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অতীতের চেয়ে খাসিদের পান উৎপাদন কমছে, কমছে মাটির উর্বরাশক্তি, বাড়ছে রোগবালাই। ফলে অতীতে যেভাবে ঋতুভেদে পান চাষ প্রক্রিয়া তারা অনুশীলন করতো সেটাতে ব্যাঘাত ঘটেছে।

জুন-জুলাই মাসে পানের চারা কাটা ও রোপণের সময় হলেও বর্তমানে অনেকে সেটা অনুসরণ করতে পারেন না মূলত কম বৃষ্টিপাতের কারণে। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ‘লংখং’ ও নতুন পান তোলার সময় হলে বর্তমানে অনেকে জানুয়ারি মাসের দিকেই জুমের সব পান তুলতে বাধ্য হয় বৃষ্টির না হওয়ায় পানের পাতাগুলো নেতিয়ে পড়ার কারণে। নতুন পান এপ্রিল-মে মাসে তোলা হলেও বর্তমানে মে মাসের দিকে তারা নতুন পানের পাতা তুলতে পারছেন। অর্থ্যাৎ স্বল্প ও বৃষ্টিহীনতার কারণে খাসিদের পানচাষের পঞ্জিকা পরিবর্তন হচ্ছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কম বা বৃষ্টিহীনতার কারণে পান চাষ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নেরিয়ুস বোআম বলেন বলেন, “জুন-জুলাই মাসে পান জুমে পানের চারা রোপণ করে থাকি আমরা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বৃষ্টির পরিমাণ এত কম যে, আমরা প্রয়োজন ও চাহিদা মাফিক নতুন চারা রোপণ করতে পারি না উপরোন্তু নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ এতো কম যে, জুন-জুলাই মাসে রোপণকৃত ওই পানের চারাগুলো খরায় মরে যায়। ফলে প্রতিবছর আমরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হই। পানজুমে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করি সেই পরিমাণ উৎপাদন হয় না। তিনি বলেন, “ইদানীং শীতকালে কুয়াশার পরিমাণ অনেক বেশি। কুয়াশায় পানের পাতাগুলো সহ্য করতে না পেরে এগুলো অকালে মাটিতে ঝরে যায়।” তিনি বলেন, “শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় এমনিতেই পান গাছ নতুন পাতা দিতে পারে না আবার কুয়াশায় এভাবে পাতাগুলো রাঙা (পেকে) হয়ে ঝরে যায় বলে আমরা আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছি। তিনি আরও বলেন, “এ বছর শিলা বৃষ্টির হওয়ার ফলে এ এলাকার প্রায় ৬০ ভাগ পানজুম ক্ষতিগ্রস্তহয়েছে।”

একই অভিজ্ঞতার কথা জানান ভারত লামিন। তিনি বলেন, “বিগত ৪/৫ বছর থেকেই শীতকালে খুব শীত আর গ্রীষ্মকালে খুব গরম পরে। এতে করে আমাদের মতো প্রকৃতি নির্ভর চাষীরা দু’দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হই। একদিকে বৃষ্টির পরিমাণ কম হওয়ায় জুমে পান উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিকে নিত্য নতুন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। পানের ‘উট্রাম’ রোগের পাশপাশি গোড়া পচা রোগও দেখা দিয়েছে। তাছাড়া পানে মড়ক এবং পানের আকার আরও ছোট হচ্ছে। পানের আকার ছোট হলে ব্যবসায়ীরা সেই পান কিনতে চায় না। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলেও পানের মূল্য কিন্তু পাঁচ বছর আগে যে জায়গায় ছিলো আজ পর্যন্ত সেই জায়গায় রয়েগেছে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাসিদের স্বাস্থ্য ও সুপেয় পানির ওপর বেশ প্রভাব পড়ছে। মার্চ-এপ্রিল মাসে সুপেয় পানির চরম সঙ্কট দেখা দেয়। এমনকি স্নানের জন্যও পানি পাওয়া কষ্টকর বলে নিরালা পুঞ্জির অনেকে জানান। এসময় ছড়া, ঝরণা ও কুয়ার পানি শুকিয়ে যায়। প্রয়োজন মতো বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং প্রচন্ড গরম ও শুষ্কতার কারণে এসব হচ্ছে বলে তারা জানান। আবার এলাকায় ম্যালেরিয়া, জ্বর, টাইফয়েড, পেট পীড়া, মাথাব্যথাসহ আরও অনেক রোগ দেখা দিয়েছে, আক্রান্ত করছে অনেকে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় খাসিদের কোনও প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকলেও এই পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন করার জন্য তাদের লোকায়ত জ্ঞান প্রয়োগ করে আসছেন। পানের চারা রোপণের সময় জুন-জুলাই হলেও বৃষ্টি যদি কম থাকে তাহলে তারা আগস্ট মাসের দিকে রোপণ করেন। অতীতে জুমের গাছপালার ডালপালা বেশি করে কাটলেও বর্তমানে হালকা করে কাটে যাতে প্রখর সূর্যতাপে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে না যায়। পানজুমের জমিতে বছরে দু’তিনবার আগাছা পরিষ্কার করলেও বর্তমানে অনেকে দু’একবার করেন। কারণ তারা মনে করে জুমে কিছু ঘাস থাকলে সুর্যের প্রখরতা প্রশমনে ঘাসগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। রাতের বেলায় পড়া শিশির ঘাসে সংরক্ষিত হয়ে মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করে। এছাড়া পান গাছের গুড়িতে জৈব সার প্রয়োগ করে গাছের লতাপতা দিয়ে ঢেকে রাখে যাতে সেখানে কুয়াশার পানি সংরক্ষিত হয়ে পানের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে পারে। এটাকে মালচিংও বলা যেতে পারে। অতীতে শুধুমাত্র পান চাষের ওপর নির্ভরশীলতা থাকলেও বর্তমানে পানের পাশাপাশি সুপারি, লেবু, শাকসবজি আবাদ করে ফসল বৈচিত্র্যতা এনেছেন অনেকে। এসব ফসল বিক্রি করে তারা সংসারের জন্য বাড়তি আয়ও নিশ্চিত করেন। অন্যদিকে খাসিরা প্রথম থেকেই গাছপালা রোপণ, পরিচর্যা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছেন; যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম প্রশমন পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা যায়। পানজুমে অসংখ্য গাছপালা, বিভিন্ন প্রজাতির লতা, গুল্ম পরিচর্যা করে খাসিরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেন। এছাড়া পানজুমে অসংখ্য প্রজাতির দেশী গাছপালা ও উদ্ভিদ থাকায় নানান প্রজাতির পশু-পাখি, সরীসৃপ, অণুজীব সেখানে বসতি স্থাপন করে। পানির সংকট নিরসণে খাসিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় কুয়ো খনন, প্রাকৃতিক পানিকে সংরক্ষণ এবং বাড়ির আঙ্গিনায় বড় ধরনের ট্যাংক নির্মাণ করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।

পান বাজারজাতকরণ: নেই খাসিদের নিয়ন্ত্রণ, হয় শোষণ
প্রকৃতির বৈরীতা, পানের নানা রোগের আবির্ভাব এবং জমির উর্বরাশক্তি কমে যাওয়ার কারণে এ সম্প্রদায়ের পান উৎপাদন এমনিতেই কমে যাচ্ছে উপরোন্ত এর সাথে যোগ হয়েছে নানা প্রতারণা ও শোষণ ও পান আমদানী। এ বছর ভারত থেকে খাসিয়া পান আমদানী করা হয়। ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশের খাসিয়া পানের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। মূলত এ সময় পানের উৎপাদন কম হওয়ায় পানের মূল্য উর্ধ্বে থাকে। খাসিরা, এ সময়ে পানের ভালো মূল্য পাওয়ায় ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে খাবার, দাবার এবং পরিশোধ করে বিভিন্নজনের কাছে নেওয়া ঋণ। কিন্তু ভারতে থেকে পান আমদানী করায় খাসিরা চরম ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হচ্ছেন। তাই অতীতে যে পরিমাণ পান উৎপাদন করে সংসারের খরচ মিটানো যেত আজ সে একই পরিমাণ আয় দিয়ে কোনওভাবে সংসারের খরচ মিটানো যায় না। অতীতের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য খাসিদের মধ্যে অনেকে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন বলে অপকটে স্বীকার করেছেন। এ ঋণের লিখিত কোনও সুদ থাকে না। তবে অলিখিত সুদ হিসেবে খাসিদের উৎপাদিত পান মহাজন নিজে বাজারজাতকরণ করেন। যে কোন ব্যবসায় ঝুঁকি থাকলেও খাসিদের সাথে মহাজনদের এই ব্যবসায় কোন ঝুঁকি নেয়। কারণ মহাজন নিজের লাভসহ আনুষাঙ্গিক খরচ কেটে নেওয়ার পরই যে খাসিদের পানের মূল্য নির্ধারণ করে দেন। এক্ষেত্রে খাসিরা তাদের পানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন কম হচ্ছে উপরোন্তু এই কম উৎপাদন নিজে বাজারজাত করতে না পারায় খাসিরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সন্মূখীন হয়েছেন। অন্যদিকে যারা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেননি তারাও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কারণে উৎপাদিত পানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পান ব্যবসায়ীদের সমবায় সমিতি রয়েছে। এ সমিতির মাধ্যমে তারা পানের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। পানের বাজারমূল্য বেশি হলেও ব্যবসায়ীরা খাসি গ্রামে গেলে সেই বাজার মূল্যের অনেক কম মূল্যে খাসিদের পান কেনে বা খাসিদের বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখানে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না। তাই খাসিদের পান যেহেতু পচনশীল দ্রব্য এবং তা সংরক্ষণের জন্য কোন হিমাগার বা সংরক্ষিত গোদাম নেই তাই ওই সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য পানের প্রকৃত মূল্যের তুলনায় কম হলেও খাসিরা ওই মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাই ঋণগ্রস্ত বা ঋণমুক্ত উভয়ই এই ব্যবস্থায় প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
OLYMPUS DIGITAL CAMERA
অন্যদিকে পান বিক্রি করে সংসার পরিচালনার জন্য খাসিদের সবকিছুই বাইরে থেকে কিনতে হয়। এখানেও খাসিরা শোষিত ও প্রতারিত হন। দ্রব্যের প্রকৃত মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি মূল্য নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে। শিক্ষা না থাকা কিংবা স্বল্প শিক্ষিত হওয়ায় খাসিরা ব্যবসার প্যাঁচ বুঝেন না। দেখা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন কারণে স্বল্প বৃষ্টিপাত ও খরায় যেমন পান উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি পুঞ্জিতে নানা ধরনের শোষণ ও হয়রানি খাসিদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নিরালা পুঞ্জির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত ৮/১০ বছরের তুলনায় তাদের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রকৃতিনির্ভর পান চাষ এখন অনেকটা অসম্ভব। তারপরও ভূ-গর্ভস্থের পানি তুলে পান জুমে সেচ ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব এবং ব্যয়বহুল। ফলে এখনও পানচাষের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন তাদের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উৎপাদন কম হওয়ায় তাদের আয় কমছে। আয় কমে যাওয়ার কারণে সংসারের পরিচালনায় বাধ্য হয়ে ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে তারা সম্পূর্ণরূপে মহাজন, ক্ষুদ্র ঋণ সংগঠন কিংবা শুটকী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন।

উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চনা, খাসিদের কৃষিব্যবস্থায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ভারত থেকে পান আমদানী, জমি হারানো, জমির মালিকানা লাভে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং এর সাথে অশিক্ষা এবং অসচেনতার কারণে নিরলা পুঞ্জিসহ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলায় বাসবাসকারী খাসিদের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন। কিন্তু এই বিপন্নতার মাঝেও তারা এখনও নিভৃতে ও নিরন্তরভাবে বন সংরক্ষণ করে আসছেন; কারণ বন জঙ্গল, পাহাড়-টিলা, গাছপালার সাথে জড়িত তাদের জীবিকা। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে খাসি জনগোষ্ঠীর প্রকৃতির সাথে এক অচ্ছেদ্য সেতুবন্ধন রচনা করে আসছেন। তাই যতবার বন উজাড়, পরিবেশ বিপন্ন ও প্রাণবৈচিত্র্য হরণপ্রক্রিয়া সংঘটিত হবে ততবার এই জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ভিত্তিকে ঝুঁকিযুক্ত ও বিপন্ন করে তুলবে। কারণ উপরোক্ত বর্ণনা থেকে জানা যায়, আদিবাসীরা সত্যিকারের বন সংরক্ষক। বন ধ্বংস ও উজার মানে জনগোষ্ঠীর জীবিকার পথকে বন্ধ করার শামিল।

খাসিরা হাজার বছর ধরে বনে ও জঙ্গলে বসবাসের কারণে প্রকৃতির সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে খাসিদের রয়েছে অনন্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় খাসিদের রয়েছে সহজাত জ্ঞান। তাই বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিতে খাসিদের এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। খাসিরা তো তাদের জীবন-জীবিকা দিয়েই প্রাকৃতিকভাবে বনায়ন করে আসছেন। শুধু তাই নয় তাদের হস্তক্ষেপে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক বনায়নকে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থপনায় খাসিরা অনেকবার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। খাসিদের কৃষি আবাদ কার্বননিরপেক্ষ। পরিবেশবান্ধব উপায়ে তারা চাষাবাদ করে আসছে। কৃষি অনুশীলনে বাইরের কোন উপকরণ ব্যবহার না করায় খাসিদের আবাসস্থলে কীটনাশক, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শ নেই বিধায় সেখানকার মাটি, পানি ও বায়ু বিশুদ্ধ।

পরিবেশবান্ধব কৃষি অনুশীলন এবং প্রাণবৈচিত্র্যসহ পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণে খাসিদের ভূমিকা অনন্য হলেও এ জাতিগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়িত বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু হওয়ার আতংকে থাকতে হয়। প্রতিটি পদে তাদের নানান হয়রানি, শোষণ, নির্যাতন সয়ে যেতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি সেবা, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা তাদের নাগালে পৌছে না। চরম বৈষম্যে তাদের জীবন পরিচালিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, খাসিসহ অন্যান্য আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমি অধিকার, বন ও জঙ্গলের ওপর তাদের প্রথাগত অধিকার স্বীকৃতি দিলে খাসিদের এসব সমস্যা সমাধানের অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক অধিকার তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে খাসিরা দেশের বনাঞ্চল রক্ষা ও সংরক্ষণে আরও দৃঢ় পদক্ষেপে চালিয়ে যেতে পারবে। এতে করে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি এই উভয় খাতের জন্য মঙ্গল ও সমৃদ্ধি যে বয়ে নিয়ে আসবে তাতে বিন্দুটুকু সন্দেহ নেই আমাদের।

happy wheels 2

Comments