দিরসিনঝি ঝর্ণার মৃত্যু: চরম পানি সংকটে স্থানীয় জনগোষ্ঠী

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

 

যেখানে জল সেখানেই জীবন। জীবনযাপনের ধরন পাল্টাচ্ছে জলের উৎসের মৃত্যুতে। এর জন্য দায়ি প্রাকৃতিক ও বিশেষভাবে মানবসৃষ্ট দূর্যোগ। সীমান্তে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীদের জীবন ও জীবিকার সাথে পাহাড়ি ঝর্ণা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এই ঝর্ণার বালি খুড়ে তারা স্বচ্ছ ও সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। মাছ, শামুক, কাঁকড়ার মতো অনেক জলাশয়ের প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে যেগুলো তাদের দৈনিক খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। ঝর্ণার পাড়ের অচাষকৃত শাকসবজি তাদের বাজার খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনে। এমনকি গবাদি পশুগুলোও নিজের মতো করে পাহাড়ে খাবার খেয়ে ঝর্ণায় এসে নিজেরাই পানি খেয়ে নেয়। আবার বোরো মৌসুমে এই ঝর্ণা বোরো ফসলসহ অন্যান্য ফসলও চাষে করে সহায়তা। কিন্তু বিগত ৬-৮ বছর ধরে পাহাড়ি ঝর্ণার মৃত্যু সীমান্তবর্তী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকায় ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

Exif_JPEG_420
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বরোয়াকোনা গ্রামটি মহাদেউ নদীর তীরে অবস্থিত। এই গ্রামে বাঙালি ও গারো আদিবাসী লিঙ্গাম ভাষাভাষীর বসবাস। এখানে প্রায় ৪৪৮টি পরিবার রয়েছে। বোরো ও আমন দুই মৌসুমে ধান চাষ হয়। অন্যান্য শাক সবজি শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা মিটানোর জন্য বসতভিটেয় চাষ করেন স্থানীয়রা। বোরো মৌসুমে ধান চাষের জন্য পাহাড়ি ঝর্ণার পানির উপর নির্ভরশীল। এই গ্রামে মোট ৩টি (পরসিন্জি, দিরস্নিজি, বরোয়াকোনা) ছোট ছোট পাহাড়ি ঝর্ণা রয়েছে। তার মধ্যে দিরসিনজি ও বরোয়াকোনা ঝরনাটি মারা গেছে আজ থেকে প্রায় ৬-৮ বছর পূর্বে। বর্তমানে শুধুমাত্র পরসিনজি ঝর্ণাটি জীবিত আছে।  এই ঝর্ণার পানি দিয়ে প্রায় ১০-১২ একর জমির সেচ সমস্যার সমাধান করা যায়। দিরসিনঝি ঝর্ণার মৃত্যু ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে ঝর্ণার প্রতিবেশীয় অঞ্চলকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে।

লিঙ্গাম ভাষায় ঝর্ণাকে বলা হয় সিন্জি। এই গ্রামের মাঝখানে দিরসিনঝি নামে একটি বিল আছে। বিল ও ঝর্ণার উৎপত্তি একই ব্যক্তির জমিতেই। তাই নামকরণটিও করা হয়েছে একই ব্যক্তির নামে। ঝর্ণাটি পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে দিরসিনঝি বিলে পতিত হয়েছিল। ফলে বিল ও ঝর্ণার পানি একসাথে মিশে ঝর্ণার নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতো সারাবছর ধরে। কিন্তু ভারতে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করার ফলে ঝর্ণাটি বালি ও পাথরে ভরাট হয়ে যায়। সেই সাথে বিলের আয়তনও খুবই ছোট হয়ে যায় এবং গভীরতা কমে যায়। বর্তমানে বিলটি ছোট একটি ডোবার মতো!

স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও গোবিন্দপুর জিবিসি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লুয়েল নংমিন (৫৫) বলেন, “দিরসিনজি ঝর্ণায় আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগে যথেষ্ট পানি ছিল। সারাবছরই পানি থাকতো। ঝর্ণায় প্রচুর মাছ ছিল, ঝর্ণার ধারে অনেক অচাষকৃত শাকসবজি ছিল।” তিনি আরও বলেন, “ঝর্ণার পানি দিয়ে ধান ও শাকসবজি চাষ করা যেতো। এই ঝর্ণা ছিল মানুষের খাবার পানির উৎস। দৈনন্দিন গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় কাজের জন্য এই ঝর্ণার পানির উপরই মানুষ নির্ভরশীল ছিল। তবে ঝর্ণা ভরাট হওয়ার সাথে সাথে সব শেষ হয়ে গেল।”

Exif_JPEG_420

দিরসিনঝি বিলটিও অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে। বিলটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন গ্রামবাসীকে অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত কিছুটা দূরের মহাঢেউ নদী থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। নদীতেও এই বছর থেকে পানি কমে গেছে। গাছপালা মরে যাচ্ছে পানির অভাবে। বর্তমানে গ্রামবাসীদেরকে শাকসবজি ও মাছ সব কিছুর জন্য বাজারের উপর নির্ভর করতে হয় প্রতিদিন। অনেক কৃষক ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না পানির অভাবে। একরের পর একর জমি পতিত থাকছে। তাই কৃষকদের মাঝে মৌসুমী বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই কথা বলেন কৃষক পুজনাথ রংদী (৬০)। তিনি বলেন, “বোরো মৌসুমে ঝর্ণাটি যদি জীবিত থাকতো তাহলে ১০-১২ আরা জমি চাষ করা সম্ভব হতো। শাকসবজি চাষ করা যেতো। ঝুকিপূর্ণ কয়লা খনিতে মানুষের কাজ করতে যাওয়ার প্রয়োজন হতোনা।

পাহাড়ি ঝর্ণার মৃত্যুর সাথে সাথে গাছপালা ও মাটির উর্বরাশক্তিরও মৃত্যু ঘটেছে। দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কের মাঝেও। দিরসিনঝি ঝর্ণার মতো মৃত্যু ঘটেছে জাগিরপাড়া গ্রামের পরসসান ঝর্ণার, পাতলাবন গ্রামের ডাঙ্গরকোনা ঝর্ণার, চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের  আব্দুল বাপ, খেত্থি, থিআ ঝর্ণার। প্রত্যেকটি ঝর্ণার মৃত্যুর কারণ ভারতের পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ ও গাছপালা কমে যাওয়া। আসামের মেঘালয় রাজ্যের পাহারগুলো থেকে উৎপত্তি ঝর্ণাগুলো ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষগুলোর মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করলেও অবকাঠামো উন্নয়ন ও পাহাড় বৃক্ষশুন্য হওয়ায় একের পর এক ঝর্ণাগুলোর মৃত্যু ঘটছে এবং পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরশীলতা বন্ধনও চ্যূত হতে চলেছে। তাই পাহাড়ি ঝর্ণা, পানি, প্রাণী, মাটি ও প্রকৃতিতে বাাঁচতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, প্রশাসন, সরকার এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকারের আরো আন্তরিক হওয়া জরুরি।

happy wheels 2

Comments