হাজংদের ঐতিহ্যবাহী চোরা মেলা

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা

আজ থেকে প্রায় শত বছরেরও অধিক সময়ের পূর্ব থেকে শুরু হওয়া চোরা মেলা কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের নোয়াগাও, শাকিলাবাম, বগাডুবি গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজং আদিবাসীদের অতি প্রাচীন একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা ও ধর্মীয় পার্বণ। চৈত্র্য সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখে এটি উদ্যাপিত হওয়ায় এর রয়েছে ভিন্নমাত্রা। এই মেলা ও পার্বণটি হাজং আদিবাসীরা উদ্যাপন করলেও এটি শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গারো আদিবাসী ও বাঙালি সম্প্রদায়ের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকেও একত্রিত করে, আনন্দ দেয় ও উৎসবমূখর করে তোলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের। অতি সাধারণভাবে এই ধর্মীয় পার্বণ ও মেলাটি উদ্যাপিত হলেও এর রয়েছে এক সমৃদ্ধময় ইতিহাস।

চোরা নামকরণের প্রেক্ষাপট
রাজাবাড়ী গ্রামের প্রবীণ ললিন্দ্র আজিম (৭৯) ও খ্রীষ্টিনা রংখেং (৯২) এর কাছ থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে মেলার স্থানের পাশের রাজাবাড়ি গ্রামে তৎকালীন রাজা উপেন্দ্র খাজনা আদায়ের জন্য সুসং দূর্গাপুর থেকে হাতিতে করে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। জিরাত (মাঝে মাঝে এসে কিছুদিনের জন্য বসতি স্থপন করা) বসতির জন্য তিনি এই গ্রামে তাবু স্থাপন করেছিলেন। জিরাত বসতি হলেও বর্তমান রংছাতি গ্রামে রাজার রংমহল ছিল। বর্তমান সতেরহাতি গ্রামে ছিল হাতির খামার। সেই সময় বর্তমান মাহাদেও নদীর গতিপথ বটতলা গ্রামের পাশে ছিল। তাই রাজাবাড়ি গ্রামে ৭টি বড় বড় পুকুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও অনেকগুলো কূপ ও পুকুর অনেক গভীর করে খনন করার পরও পানির উৎসের সন্ধান মেলেনি। তাই এই গ্রামে অবস্থান করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি এ এলাকায় স্থায়ীভাবে আসা যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই গ্রামে অস্থায়ী অবস্থাকালীন সময়ে তিনিই সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজা ও ছোট খাট মেলা শুরু করেছিলেন।

orpona
রাজার চলে যাওয়ার পর বগাডুবি গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজং আদিবাসীরা নিয়মিত এই দেবীর পুজা উপাসনা করেন। গ্রাম থেকে পুজা মন্ডপটি খানিকটা দূরে হওয়ায় পরবর্তীতে শালিকাবাম ও নোয়াগাও গ্রামের হাজংদের কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর থেকেই প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির সময় সন্ধ্যা থেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর নামে পুজা ও  সারারাত ধরে কীর্তন গাওয়া হয় কালের সাক্ষী হয়ে থাকা মাহাদেও গ্রামের বটবৃক্ষের ছায়াতলে। পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের সকাল প্রায় ১০.০০ মি: পর্যন্ত পুজা হয়। প্রসাদ বিতরণ করা হয়। হাজং ছাড়াও সকল ধর্মের ও সম্প্রদায়ের মানুষও মানসি (কবুতর, পাঠা) দিয়ে থাকেন। সকাল থেকে মানুষের সমাগম ঘটলেও মেলা জমে উঠে বিকেলের দিকে।
প্রশ্ন জাগল সিদ্ধেশ্বরী দেবীর নামে যদি পুজা হয়ে থাকে তাহলে মেলার নাম চোরা হল কেন? এর ব্যাখ্যা দুই প্রজন্মের কাছ থেকে দুই রকমভাবে পাওয়া যায়। শিশু থেকে মধ্য বয়স্করা জানেন মেলার স্থানে ছিল একসময় মাহাদেও নদীর বালির চর ও তপ্ত চরা (প্রচন্ড তাপদাহ) দিনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে চরা মেলা। আবার প্রবীণদের মধ্যে নির্মলা হাজং (৮২) জানিয়েছেন, রাজাবাড়ি গ্রামে একসময় রাজার জিরাত (মাঝে মাঝে এসে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করা) বসতি ছিল। সেই রাজাই এই জায়গাই সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজা করতেন। তখন এই স্থানে প্রচুর জঙ্গল ছিল। পুজা দেওয়ার সময় পুজার উপকরণ সামগ্রী  (গামছা, ধুতি, প্রসাদ প্রভৃতি) চুরি করে চোরেরা জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে রাখতেন। এছাড়াও ছোট খাট মেলার দোকান থেকেও পণ্যসামগ্রী অনেক চুরি হতো। সেই কারণেই এই মেলার নামকরণ করা হয়েছিল চোরের মেলা। কালক্রমে সেই নাম পরিবর্তীত হয়ে চোরা হয়ে যায় এবং চোরা মেলা নামটিই সর্বজনের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। যারা এই ব্যাখ্যাটি শুনেছেন তারা এখন এটাই সঠিক বলে মনে করছেন।

চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের ধরন
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে হাজং আদিবাসীরা সামাজিকভাবে সংগঠিত হয়ে পুজার স্থান পরিস্কার করেন এবং সামর্থ্য অনুসারে সজ্জিত করেন। প্রতিঘর থেকে ২০০ টাকা  চাঁদা তোলে পুজা ও মেলার আনুষাঙ্গিক খরচ জোগার করেন। নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনকেও সম্পৃক্ত করেন। এছাড়া নিজ নিজ বাড়িতে নারীরাও ঘর লেপেন, বাড়ির চারপাশ পরিস্কার করেন, ঘরের আসবাবপত্র সব ধৌত করেন। বাদ যায় না ঝাড়–, পাখা, শিলপাটা, দাঁড়িপাল্লা পর্যন্ত। গোয়াল ঘরও পরিস্কার করেন এবং গোয়াল ঘরের মাঝখানে অনেকটা প্রাচীত ঐতিহ্য ও রীতি মেনেই এক খাঁচা মাটি দেন গবাদি পশুর মঙ্গলার্থে। এই প্রসঙ্গে নির্জলা হাজং (৮২) জানান, পূর্বে সারাবছর ধরে সংরক্ষণে রাখা হাত পাখা চৈত্র সংক্রান্তির দিনে না ধূওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেই হাত পাখা ব্যবহার করতেন না। তিনি আরও জানান, পহেলা বৈশাখের দিনে সকাল হতেই ঘিলা (ঘিলা একধরনের জংলী গাছ) বীজ গুড়ো করে সাথে খাটি সরিষা তৈল, পানি ও আবির একসাথে মিশ্রণ করে বসতভিটের চারপাশ, ঘরবাড়ী, আসবাপত্র, গোয়াল ঘর সব জায়গায় ছিটিয়ে দিতেন। তাছাড়া ডায়নিউকা (লতানো জংলী গাছ) বেত পাতা, ইকরের আগা, গোড়াপাংখা (বৃষ্টি গাছে জন্মানো পরজীবি উদ্ভিদ) এক সাথে বসতঘরের দরজার সামনে চালের উপর রেখে দিতেন বাড়ির সারাবছরের মঙ্গলার্থে। বর্তমানে এই উপকরণগুলো পাওয়া যায় না বলে বর্ষ বরণের এ রীতি সেই করমভাবে মানা হয় না। তবে এখনও কিছু কিছু জায়গায় বেত ও পাতা মিলে। তাই এখন বেত ও পাতা দিয়েই পূর্বের ঐতিহ্যকে ধরে রাখছেনন অনেকে।

Exif_JPEG_420

এই দিনটিতে জাতীয় শাক ও সবজি খাবার প্রথার গুরুত্ব সম্পর্কে গুলগাও গ্রামের পুটুনা হাজং (৮০) জানান, পূর্বে পহেলা বৈশাখে ১০৮টি জাতের শাক মিশ্রণ করে তরকারি রান্না করা হতো। এর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, বাঁশ প্রভৃতির কচি পাতা পর্যন্ত তালিকার অন্তর্ভূক্ত ছিল। তার মধ্যে টিটা জাতীয় শাকের পরিমাণ বেশি থাকতো। আর অবশ্যই নিম পাতা, অচাষকৃত গিমা টিটা শাক থাকতো। আর সব উপকরণই সংগ্রহ করা হতো বন জঙ্গল থেকে। এর আনন্দই ছিল ভিন্ন রকম। তাদের বিশ্বাস ছিল বছরের শুরুতে টিটা জাতীয় শাক খেলে সারাবছর শরীর সুস্থ থাকবে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “বর্তমানে ১০টি জাতের অচাষকৃত শাক মিলানোই কঠিন বলে ৫-৭টি জাতের শাক দিয়েই রান্না করতে হচ্ছে। তবে তরকারিতে অবশ্যই এক টুকরা হলেও আমকুড়া (কচি আম) দিতে হয় এবং এদিনের পর থেকে আম খাওয়া শুরু করতে হয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই দিনের এতো আয়োজন করে আম খাওয়া অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষা করে না। এই নিয়মটি তারা মানতেই চায় না।”

এছাড়াও এদিন প্রতিটি হাজং বাড়িতে নিজেদের হাতে তৈরি করা বিন্নি ধানের খইয়ের দেখা মেলে। বিভিন্ন জাতের পিঠা তৈরি করেন। পিঠা, চিরা মুড়ি, খই, দই, গুড় দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। শুধুমাত্র এদিনে খই, পিঠা তৈরি করতে হবে এবং অতিথি আপ্যায়ন করতে হবে বলে অনেক পরিবার বিগত বছরের আমন মৌসুমের বিন্নি ধান

Exif_JPEG_420

অতি যত্নে সংরক্ষণ করে রাখেন। সব সময়ের চিরচেনা সকালের নিরবতা এদিন কোলাহলপূর্ণ সকালে পরিণত হয় শিশু কিশোরদের রঙ উৎসবের জন্য। বাদ যায় না গবাদি পশুগুলোও। সকালে গরু, ছাগলগুলোকে স্নান করিয়ে সাথে কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি, কবুতর প্রভৃতি প্রাণীদের কলকে দিয়ে রঙ মাখিয়ে রঙিন করে তোলেন এবং নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় তাদেরকেও সম্পৃক্ত করেন।

অধিকাংশ হাজং জনগোষ্ঠীর অভিমত, তারা যতগুলো পুজা পালন করেন তার থেকে এটি ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্পৃক্ততায় পুজা ও মেলা দুটোই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে পুজা কমিটির যুব সদস্য অজন্ত হাজং (২২) বলেন, “যদি পুজা ও মেলার জায়গায় কারেন্টের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে ২-৩দিন পর্যন্ত মেলা রাখা যেতো। হাজং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পূর্ব ইতিহাসগুলোকে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারতাম।” শত বছরেরও অধিককালের ঐতিহ্যবাহী এই পুজা ও মেলার স্থানটিতে এখন পর্যন্ত তেমন কোন পরিবর্তন নেই। পবিত্র পুজা মন্ডপের পবিত্রতা সব সময়ের জন্য বজায় রাখার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তাই উদ্যোক্তারা বলেন, “যদি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে মন্ডপের চতুর্দিকে দেয়াল দেওয়া হতো, বৃক্ষ রোপণ করে এর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা হতো। কারণ চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখে এটি উদ্যাপন করায় এলাকা ছাড়াও এলাকার বাইরের অনেক দূর দূরান্তের মানুষ এখানে আসেন  বিনোদনের উদ্দেশ্যে এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আসেন আত্মিক সান্নিধ্য পাবার জন্য।”

happy wheels 2

Comments