তানোরে উজানের ঢলে ডুবছে কৃষকের ফসল: ফসল রক্ষার উদ্যোগ নিন

তানোর রাজশাহী থেকে মিজানুর রহমান

যে সময় কৃষক নতুন ফসল ঘরে তোলার কথা, সে সময় রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবনদীর বিলকুমারী বিলে চোখের সামনে উজানের ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কাচা-পাকা ফসল। এ যেন সম্পদহানী নয়, গরিব খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্নভঙ্গ। আর সে স্বপ্ন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তানোরের প্রান্তিক কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে তানোরে প্রায় ১৪ হাজার ৮৫৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে শিব নদীর বুকে রোপিত প্রায় ৪ হাজার হেক্টর বোরো ধান কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ ও পাশ্ববর্তী নওগাঁ জেলার মান্দা ও আত্রাইয় উপজেলার শিবনদীর শাখা বেয়ে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে গেছে।
Tanore
হঠাৎ প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে ভালো ফলন হয়েও বিপর্যয় ঘটেছে বোরো ধানের। উপজেলার চাঁন্দুড়িয়া থেকে চৌবাড়িয়া মালশিরা পর্যন্ত অধিকাংশ জায়গায় বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। যা গতকাল (মঙ্গলবার) দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থেকে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিলের বিস্তৃীর্ণ ফসলের মাঠ প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের। তারা জানান, নিজেদের কষ্টের কথা। চান প্রধানমন্ত্রীসহ সবার সহযোগিতা।

বোরো চাষীরা জানান, বছরে একবারই তারা এ বিলে ধান চাষ করেন, যা দিয়ে সারাবছর চলেন। তবে এবার পাকা ধান কাটার সময়ে আগাম বৃষ্টি কৃষকের সব স্বপ্ন ¯œান করে দিয়েছে। বোরো ধান নিয়ে কৃষকের এমন আহাজারি শুরু হলেও স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে উদাসীন। তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে কৃষকের অভিযোগ।

কৃষকরা জানান, গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিলকুমারী বিলের পানি হঠাৎ ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গত ২৫ এপ্রিল থেকে এই বিলের জমির ধানও ডুবতে থাকে। সবচেয়ে বেশি ধান ডুবতে শুরু করেছে গত শুক্রবার থেকে। ওইদিন এ বিলের কৃষকদের জমির ধানও একের পর এক ডুবছে। আবার ডুবে যাওয়ার ভয়ে আধা-পাকা অবস্থায় কেটে নিচ্ছেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে অনেক স্থানে অর্ধেকভাগেও শ্রমিকের অভাবে সেই আধা-পাকা ধান কাটতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের। এতে করে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন দুই উপজেলার অন্তত সাড়ে ছয় হাজার কৃষক।

স্থানীয়রা জানান, বিলের জমিতে অন্য সময়জুড়ে পানি জমে থাকে বলে জমিও থাকে উর্বর। ফলে অন্যান্য জমির চেয়ে এই বিলের জমিতে ধানচাষ করতে খরচ অনেকটা কম হয়। তারপরও অনেক বর্গাচাষী রয়েছেন, যাঁরা অন্যের জমি ধানচাষের জন্য বর্গা নিয়ে ধানচাষ করেন। কিন্তু এবার সব বর্গা চাষীদেরকেই পথে বসতে হবে জমির ধান পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে। আবার অধিকাংশ কৃষকই গরিব এবং মধ্যবিত্ত হওয়ায় তাঁরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
Photo of the destruction of Boro cultivation in Tanore Bill -04 01.05.2017
তানোর উপজেলার চাপড়া গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান বলেন, “বিলকুমারী বিলে আমার দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি, কিন্তু বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গেছে। প্রতিবছর আমরা এ সময়টার জন্য অপেক্ষা করি ঘরে ধান তুলতে। কিন্তু এবার সেটা আর হলো না।” প্রতিবছরই বিলের নিম্নাঞ্চলের কিছু না কিছু বোরো ফসল ক্ষতি হয়, কিন্তু এবারের অকাল বৃষ্টিতেই বেশি ক্ষতি হয়েছে বোরো আবাদের। এক রাতের ব্যবধানেই সব পানিতে তলিয়ে গেছে তাঁর।

গোকুল গ্রামে গোলাম রাব্বানী নামে এক কৃষক বলেন, “আমার নিজের তেমন জমি নেই। ঋণে টাকা নিয়ে অন্যের জমিতে ধান চাষ করেছি। আমার অধিকাংশ ধান পানির নিচে চলে গেছে।” তিনি বলেন, “অন্য বছর ঘরের খোরাক রেখে বাকিটা বিক্রি করতাম। যা টাকা আয় হতো তা খাটিয়ে আরো বাড়তি কিছু আয় হতো। আর এবার এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধান আবাদ করেছি। ফসল তো ঘরে তুলতেই পারিনি, উল্টো এখন মাথায় ঋণের বোঝা।”

উপজেলার ধানতৈড় গ্রামের কৃষক সাফিউল ইসলাম জানান, গত বছর ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেন তিনি। প্রতিবিঘা জমিতে ২৩ থেকে ২৮ মণ (২৮ কেজিতে কাচির মণ) ধান হয়েছিল। কিন্তু এবার প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে এবং অসময়ে ধান কাটার কারণে ফলন অর্ধেকেও পাওয়া যাবে না। মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম গ্রামের কৃষক আব্দুল আওয়াল জানান, এবার তিনি বিলকুমারী বিলে ছয় বিঘা জমিতে ধানচাষ করেছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় দেড় বিঘা জমির ধান পানির ঢলে ডুবে গেছে। তবে তীব্র শ্রমিক সংকটে অর্ধেক ভাগ দিয়ে কোনোমতে দুই বিঘার জমির আধা-পাকা ধান কাটতে পেরেছেন তিনি।
Photo of the destruction of Boro cultivation in Tanore Bill -01 01.05.2017
তানোর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম মোল্লা জানান, ইতিমধ্যে রাতের আধারেই বিলকুমারী বিলের বেশ কিছু জমির বোরো আবাদ পানির নিচে চলে যাওয়ায় ধান গাছে পচন ধরতে শুরু করেছে। পানি বাড়তে থাকায় কৃষকরা এই ধান আর ঘরে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মোহনপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রহিমা খাতুন বলেন, “এ উপজেলার কৃষকদের খুব বেশি জমি নেই এই বিলে। তবে উজানের ঢলে কিছু কৃষকের জমির ধান ডুবে গেছে খবর পেয়ে এই বিলে মোহনপুরের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

এদিকে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার বোরো চাষীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।” এ ব্যাপারে তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহা: শওকাত আলী বলেন, “বিলকুমারি বিলের পানিতে বেশ কিছু জমির ধান ডুবে গেছে বলে শুনেছি। কৃষি ও পিআইও অফিস মিলিয়ে উপজেলায় অকাল বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত নিরূপণের কাজ চলছে।” চূড়ান্ত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

happy wheels 2

Comments