বর্ষায় নারীদের কষ্টের জীবনযাপন ও জ্বালানি ব্যবহার

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার প্রত্যন্ত সোদঘাটা গ্রামের গৃহবধূ আছমা আক্তারের ৫ সদস্যের সংসার। অসুস্থ স¦ামী, বৃদ্ধা শাশুড়ী আর ২ সন্তান নিয়ে গত সপ্তাহ খানেক ধরে তার জীবন নামচার কষ্টের পরিসংখ্যান চোখে না দেখলে বুঝা মুশকিল। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ঘরের মেঝেতে হাঁটু পানি। ইট দিয়ে উঁচু করে পাতা হয়েছে চৌকি। তাতেই সবার বসবাস। তলিয়ে গেছে রান্নাঘর ও টয়লেট। প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনদের দান দক্ষিণায় খেয়ে না খেয়ে কোনরকম বেঁচে আছে পরিবারটি। আর স্বামী, শাশুড়ি ও দুই শিশু সন্তানকে দেখাশোনা, দুমুঠো রান্নার ব্যবস্থা, তাদের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করার সবটুকু দায়িত্বই আছমা আক্তারের করতে হয়। সহায়তার চাল, ডাল কিছু পেলেও রান্না করার জ্বালানি সংকটে একবেলা রান্না করেন তিনি। শুক্রবার সকালে নৌকা নিয়ে তার বাড়ি গেলে দেখা যায় হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে তিনি রান্না ঘরের চালে মাটির চুলায় ভাত রান্না করছেন। ভিজা কাঠ আর স্যাঁত স্যাতে চুলায় আগুন যেন ধরতেই চায় না। চারিদিকে ধোয়ার কুন্ডুলীর মধ্যে অনবরত ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাবার চেষ্টারত গৃহবধূটির কাশতে কাশতে হেঁচকী উছে যায়। এমনই পরিস্থিতিতে সীমাহীন কষ্টে পরিবারের সদস্যদের দুমুঠো খাবার ব্যবস্থা করত হচ্ছে জেলার কমপক্ষে ৩০ হাজার নারীর।

01

প্রকৃতির ঘনঘটা ও জোয়ার ভাটার অমোঘ বিধান অনুযায়ী মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আষাঢ়-শ্রাবণে নিয়মিত বর্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অনিয়মিত বর্ষা ও হঠাৎ বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। রাজধানীর নিকটবর্তী মানিকগঞ্চ জেলা। এখানে কৃষিক্ষেত্রে রয়েছে বৈচিত্র্য, রয়েছে জলাবদ্ধতা ও জলজটের সমস্যা আর সেই সাথে দেখা দেয় প্রচন্ড জ্বালানি সংকটের। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি অনবরত মোকাবেলা করে টিকে আছে গ্রাম-বাংলার প্রান্তিক হাজারো নারীরা। হঠাৎ বর্ষা ও বন্যার প্রস্তুতির অন্যতম হলো জ্বালানি সুরক্ষা। তীব্র জ্বালানি সংকটে মানিকগঞ্জের বন্যা উপদ্রুব এলাকার নারীদের জনজীবন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। বন্যায় জমি ও আশপাশের জায়গা তলিয়ে যাওয়ায় এবার জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন এ অঞ্চলের হাজারো নারীরা।

02

মানিকগঞ্জের গাংডুবী গ্রামের নারীরা এখন বাছনা পাট নিতে ব্যস্ত। জেলে পাড়ার আরতী রাণী রাজবংশী (৭০) বলেন, “আমরা বছরে একবার বাছনা পাট নেওয়ার সুযোগ পাই, সেটি ভালো পাটের মধ্যে যেগুলো ছোট সেগুলো কেটে জাগ দেওয়া হয়। আমরা সেগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে কৃষকদেরকে দিয়ে দেই। আমরা শুধু খড়ি পাই তাতেই আমরা খুশি। কারণ এই খড়ি দিয়ে বাড়ির চারপাশে, রান্না ঘর ও সৌচাগারে বেড়া দেই।” তিনি আরও বলেন, “সবচেয়ে বড় উপকার হলো সারাবছর প্রথমেই খড়ি দিয়ে জ্বাল ধরাতে হয় তাতে সারাবছরের জ্বালানি হয়। যারা এই কাজ করেন না তারা আমাদের কাছ থেকে খড়ি কিনে নেয় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। এতে আমরা কিছু টাকা পাই এবং আমাদের তো আর কিনতে হয়না এতে সংসারে উন্নতি হয়।”

বানিয়াজুরী ইউনিয়নের রাথুরা এলাকার আছিয়া বেগম বলেন, “আমরা এখন জ্বালানি সাশ্রয় করার জন্য শিকের চুলা ব্যবহার করি। এতে গোবর দিয়ে গোবর লাঠি ও ঘসি ব্যবহার করা যায়। জ্বালানি কম ব্যয় হয় এবং ধোয়া কম লাগে।”

03

মানিকগঞ্জের সবচেয়ে নিঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত গাংডুবী গ্রাম। চারদিকে থৈ থৈ পানি। ঘর বাড়ি পানিতে নিমজ্জিত। এ গাঁয়ের জেলে পেশায় যাদের জীবন তাদের অধিকাংশ সময় নৌকার মধ্যে থাকতে হয় এবং নৌকার মধ্যে রান্না বান্না হয়। এই প্রসঙ্গে নেধুরাম মাঝির স্ত্রী লক্ষ্মী রাজবংশী বলেন, “পুরুষ মানুষ মাছ ধরার জন্য নৌকা, জাল, বেসাল,বাঁশ ইত্যদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর আমরা রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের পেশাকে বাঁচাতে হলে প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর থাকতে হবে যাতে মায়েরা পর্যাপ্ত জ্বালানি পায়।”

এদিকে বন্যার অজুহাতে কাঠ, লাকড়ি, শুকনো বাঁশ, পাট কাঠি, কাঠের ভূষিসহ অন্যান্য জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দামও বেশি হাঁকছেন ব্যববসায়ীরা। ফলে গ্রামের নি¤œ আয়ের মানুষজন পড়েছেন বেশ বেকায়দায়।

happy wheels 2

Comments