ভাঙন কবলিত মানিকগঞ্জের ৩০ হাজার মানুষের বিবর্ণ ঈদ

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানকিগঞ্জ) ॥

সকাল থেকেই অবিরাম বর্ষণ। চারিদিকে বন্যার পানি আর নদী ভাঙনের শব্দে তীব্র ভয়াবহতা। আতংক, অভাব ও চরম হতাশায় নির্ঘুম ঈদ কাটে যমুনাপাড়ের সহস্রাধিক পরিবারের। ঈদে ছিল না বাড়তি আয়োজন-আনন্দ। এমনই কঠিন পরিস্থিতি, মানিকগঞ্জের বসবাসরত পদ্মা, যমুনা ও কালিগঙ্গার ভাঙন কবলিত বাসিন্দাদের। প্রতিনিয়ত ভাঙন তাড়া করেছে তাদের। কেড়ে নিয়েছে চোখের ঘুম। এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দের নয়; কেবলই বিবর্ণ বেদনার।

Manikganj Picture. 31

বন্যা ও ভাঙনের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে আমৃত লড়াই করে পদ্মা-যমুনা পাড়ের সংগ্রামী মানুষরা। তারপরও তারা পরাজয় শিকার করে না। তবে মাঝে মাঝে তারা যেন হয়ে পড়ে দিশাহারা। এবারও তেমন অবস্থা হয়েছে। এবারের বন্যায় ফসল আর নদী ভাঙনে বসত বাড়ি-সম্পদহানির সাথে সাথে মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলের কৃষকের মুখ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঈদুল আযহার আনন্দও। এ কারণে বিষাদ বিরাজ করছে দৌলতপুর উপজেলার নদী ভাঙন কবলিত হাজার খানেক পরিবারের মানুষের মাঝে। যমুনার চরাঞ্চলের দুর্গত এলাকায় কোরবানির সংখ্যাও অনেক কম হয়েছে বলে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা জানান।

এদিকে ধলেশ্বরী ও যমুনা নদীর করাল গ্রাসে ইতোমধ্যে ৩ শতাধিক পরিবারের বসত বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, কয়েক শত একর জমির তিল, কাউন, আমন ধানের আবাদি জমি নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। ভাঙন আতংকে দিনাতিপাত করছেন আরো ৫/৬ শ’ পরিবার। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার শ্রীধর নগর, কুস্তা, মাইলাঘী ও পাশ্ববর্তী দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা, চরকাটারী ইউনিয়নে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।

গতকাল সরজমিন বাচামারা ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ভিটে মাটি হারিয়ে নদীর চরে অন্যের জায়গার উপর বাড়া নিয়ে অস্থায়ীভাবে বাড়িঘর তৈরি করে ঠাঁই নিয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাচামারা আমেনা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নদী ভাঙনের শিকার কমপক্ষে ২০টি পরিবার ছেলে-মেয়ে গবাদি পশু ও বাড়ির অন্যান্য মালামাল নিয়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিনের ডেরা (ছাউনী) দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঈদ আনন্দের ছিটেফোটাও নেই তাদের চোখে মুখে।

নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো মফজেল শেখ জানান, সর্বনাশা যমুনা তার সহায়সম্বল সব গিলে ফেলেছে, এমনকি ঘরের আসবাবপত্রও রক্ষা করতে পারেননি। নতুন জামা কাপড় তো দূরে থাক, ঈদে ছেলেমেয়ের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে পারেননি। কথাগুলো বলার সময় ছলছল নয়নজুড়ে তরতর করে বেরিয়ে এলো তার ভেতরের চাপা কান্না।

2 (1)

যমুনা নদীর ভাঙনে বাচামরা ইউনিয়নের চুয়াডাঙ্গা, বাচামারা জেলেপাড়া, চরবারাঙ্গা, বাচামারা উওর খন্ড, সুবুদ্দিয়া গ্রামের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন যমুনা নদীর চরে নিজের ভিটে মাটি হারিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন অন্যের জমির ওপর আশ্রয়ের আশায়।
চরবারাঙ্গা গ্রামের সমেজ প্রামাণিক জানান, তিনি গত ২০ বছরে ৮ দফা ভাঙনের শিকার হয়েছেন। তার ৪০ বিঘা জমি ও ঘরবাড়ি ছিল। এখন কিছুই নেই, সবই নদীতে বিলীন হয়েছে।

চারদিকেই যমুনা নদীবেষ্টিত চরের আক্কাছ প্রামাণিক বলেন, “কর্জ কইরা ফসল করার পর এবারের বানে ভাসাইয়া নিল সব ফসল, কিসের ঈদ কিসের আনন্দ। আমাগো কপালে কোনো শান্তি নাই।”

এদিকে ভাঙনের শিকার অনেক লোকজন পরের বাড়িতে এখন আশ্রিত। এদের তিন বেলা পেটপুরে খাওয়া তো স্বপ্ন, অধিকাংশই একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। ঈদের আনন্দ নেই বরং গৃহপালিত পশু ঈদ বাজারে বিক্রি এবং সহায় সম্বল বন্ধক রেখে অনেক পরিবার পেটের আহার যোগাচ্ছে। এবার যমুনার চরাঞ্চলের দুর্গত এলাকায় কোরবানির সংখ্যাও অনেক কম হয়েছে বলে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

happy wheels 2

Comments