প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ
??????????????

প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥

প্রবীণ শব্দটা শোনা মাত্রই আমাদের চোখের সামনে যে-ছবিটা ভেসে ওঠে, তা হলো একজন শুভ্রকেশধারী মানুষ, যিনি বয়সের ভারে এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাতর। কেউ কেউ অত্যন্ত অসহায়ভাবে জীবনযাপন করে থাকেন। আমরা তাদের সম্মান মর্যাদা কতখানি দিয়ে থাকি জানি না, তবে অযত্নে, অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারলে যেন বাঁচি। মনে করে থাকি বৃদ্ধ আর ক’দিন বাঁচবে? তার জন্য সময় নষ্ট করার দরকার কী? এটা কখনও আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা মূল্যবোধ হওয়া উচিত নয়।

01 (1)

প্রবীণ শরিফা বেওয়ার বয়স ৭০ পেরিয়েছে বছর খানেক আগেই। মানিকগঞ্জের বরংগাইল এলাকায় থাকেন অন্যের দয়ায় এক পরিত্যক্ত ভিটেবাড়িতে। দুই মেয়ে ও এক শিশু ছেলেকে রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর শরিফা বেওয়ার দুঃখের উপাখ্যান বড়ই কষ্টের বড়ই দুঃখগাঁথা। জীবনের তাগিদে আর সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে তিনি মাটি কাটার কাজ, অন্যের বাড়িতে, হোটেলে ঝি’য়ের কাজ করেছেন। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হতো তার জীবন সংগ্রাম; সূর্য ডোবার পরও যেন তা শেষ হবার নয়। এমনি করে কেটে গেছে জীবনের ৩০টি বছর। ছেলের পড়াশোনা আর মেয়ে দুজনকে বিয়ে দিতে বিক্রি করতে হয় স্বামীর শেষ সম্বল ভিটেটুকু। ছেলে এখন বিয়ে শাদী করে গাজিপুরে থাকে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পেশাক তৈরি কারখানায় চাকুরি করে। ছেলে-মেয়েরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলেও খোঁজ নেয় না বৃদ্ধা মায়ের। বয়স হয়ে গেছে, এখন আর আগের মতো শক্তি- সামর্থ্য নেই। তবুও পেটের তাগিদে তার জীবনযুদ্ধ যেন ফুরায় না। অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের কাছে হাত পেতে জীবনকে ঠেলে নেওয়ার শেষ চেষ্টারত দুঃখিনী শরিফা বেওয়া আহাজারী, “আল্লায় এত মানুষ নেয়, আমারে ক্যান মরণ দেয় না” ।

রাশেদা বেগম নামের ৭৩ বছরের এক মায়ের ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের আশ্রয়ে ছিলেন। ভাই মারা যাওয়ার পর ছেলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। সেই যে গেছে, আর কোনো দিন দেখতে আসেনি। ‘আমাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন অসুবিধা হতো? তার পরও আমি তো মা। তাই তো সব সময় চাই, আমার ছেলেমেয়েরা ভালো থাকুক, আরও বড় হোক।’ বললেন রাশেদা বেগম। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়েছে তাঁর। বছর সাতেক আগে গাজীপুরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেন তিনি।

“ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী/ সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।” -জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গাওয়া এই গানের মতোই কমদামী বনে যাওয়া রাশেদা বেগম মতো আরও অনেকেরই জীবন সায়াহ্নে এসে ঠাঁই নিয়েছেন এখানে। আবার শরিফা বেওয়ার মতো অনেক অসহায় প্রবীণরা জীবন যন্ত্রনা আর স্বজনদের উপেক্ষার শিকার হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করে বেঁচে আছেন। আত্মীয়স্বজন, সন্তানের সান্নিধ্য, সন্তানকে একটু দেখার জন্য যেন কাঙালের মতো পথ চেয়ে থাকেন উপেক্ষার শিকার একেকজন প্রবীণ। প্রিয় সন্তান তাঁদের দূরে ঠেলে দিলেও দিনমান সেই সন্তানেরই মঙ্গল কামনা করেন তারা।

??????????????

আগেকার সমাজে বৃদ্ধজন বেশ সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বৃদ্ধদের ওপর এই শ্রদ্ধা ও সম্মান অক্ষুন্ন ছিল। বিশেষ করে প্রাচ্য সমাজে বৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য আজো মোটামুটি লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবার কারণে বৃদ্ধদের মর্যাদা কমে গেছে। সেখানে প্রবীণদের বস্তুগত কল্যাণ ও সমৃদ্ধির ব্যাপারে অবশ্য চেষ্টা যে হচ্ছে না তা নয়। তবে প্রাচ্যের বৃদ্ধজনেরা যে রকম সম্মান ও যতœ পান পুরো সমাজ এবং পরিবারের পক্ষ থেকে পশ্চিমা সমাজে তেমনটা নেই। উন্নত সমাজের বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই এর জন্যে দায়ী বলে মনে করেন বিশষ্টজনেরা।

১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রবীণদের অধিকার রক্ষা ও পুণর্বাসনের দাবিতে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্টিত ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’

৬০ বছর পার হলেই প্রবীণের ঘরে নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হয়ে উঠেছেন তারা। জাতিসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী জন্মের পর বাংলাদেশের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০.০৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের আয়ু ৭০.০৬ বছর, নারীর ৭১ .৯৮ বছর। আর ৬০ বছর বয়সের উর্ধে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ বসবাস করছে। এদের কেউ কেই একশ বছরের মতো বয়সেও দীর্ঘ জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে নারী প্রবীণরা দীর্ঘজীবী হলেও তাদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। এ দুঃসহ জীবনযাপন শুধুমাত্র আসহায়ত্ব ও দূর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছু নয়।

পরিবারের প্রধান হয়ে একদিন যিনি পরিবারকে আগলে রেখেছেন, সব দায়দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পরিবারের মঙ্গল কামনা করেছেন, বার্ধক্যে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তিনি একাকি জীবনযাপন করেন। নিজের গড়া সাজানো পরিবারটির কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যান তিনি। আস্তে আস্তে নিজের চিরচেনা পরিবারটি কেমন যেন অচেনা হয়ে যায় তার কাছে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে থাকে পরিবারের নিয়ম শৃঙ্খলায় এবং আচার আচরণেও। ঢিলেঢালা হতে থকে সম্পর্কগুলোর বন্ধন। আর সেই পরিবারের চেনা জীবন চেনা সংসার অচেনা হয়ে চলে যায় দূরে, বহু দূরে। মনের মধ্যে তৈরি হয় গভীর শূন্যতা। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু এখনকার আত্মকেন্দ্রিক সমাজে যখন পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে আসছে তখন বৃদ্ধ মা বাবা আর সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে একটি আবেগের শক্ত বাধন আলগা হয়ে গেছে। বেড়ে গেছে মনের দূরত্বও।

01 (4)

পরিবারের বয়স্ক মানুষকে মান্য করা, তাকে একটুখানি গুরুত্ব দেওয়া, তার অসুবিধার জায়গাগুলোতে তাকে সাহায্য করা, তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা এতো ছিল এক সময় আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের গৌরবোজ্জল ইতিহাস। এমনও মূল্যবোধ এক সময় সমাজে ছিল যে, একজন বয়স্ক মানুষ ঘরে থাকলে মনে করা হতো পরিবারটি একটি বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার নিচে রয়েছে। কিন্তু এই আধুনিকায়নের যুগে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশে স্বাধীনতার নামে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় পরিবারের মানুষগুলো। পরিবারের বয়স্ক মানুষটিকে অমান্য করে, তার ভালোবাসার বাইরে গিয়ে আমরা যে স্বাধীনতার কথা বলি তা হচ্ছে সন্তানকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া। বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়নের প্রভাবে পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে একক পরিবার বা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। এই অণু পরিবারগুলোর সন্তানেরা যখন দেখছেন মা বাবা, দাদা দাদি বা নানা নানির দেখাশোনা করছেন না তখন তাদের অবচেতন মনে দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা গেঁথে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তারা এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন। অনেকে পেশাগত ব্যস্ততার কারণে, অনেকে আবার জীবনসঙ্গীর বাঁধায় এ দায়িত্ব এড়াতে চান। অনেকে পিছপা হয় অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায়, কেউ কেউ স্্েরফ আত্মকেন্দ্রিকতায় কিংবা স্বার্থপরতায়।

ইসলাম বৃদ্ধদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়েছে। রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি একজন বয়োবৃদ্ধের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে কিয়ামতের দিন সকল ভয় ভীতি আশঙ্কা থেকে নিরাপদ রাখবেন’। বৃদ্ধদের শ্রদ্ধা সম্মান করা আর ছোটোদের স্নেহ করা ইসলামী নৈতিকতার অন্যতম বিধান।

বার্ধক্য জীবনের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। বেঁচে থাকলে বার্ধক্য আসবেই, আমরা সবাই বৃদ্ধ হবো। প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ, আমাদের কাছে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে চলমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। যাদের জন্য পৃথিবীর আলো দেখা, যার হাত ধরে হাটতে শেখা, যার দেখানো পথে পথ চলা, তার জন্য কি আমরা কিছুটা সময়, কিছুটা মনোযোগ দিতে পারিনা? বয়স্ক মানুষটি থাকবেন সব কিছুতে সবার সঙ্গে এমন অনুভূতি, এমন ভরসা যদি তাকে দেওয়া যায় তবে যতটা দিন তিনি বেঁচে থাকবেন অন্তত নিজেকে মূল্যহীন ভাববেন না। এই আধুনিকায়নের যুগে একজন মানুষের অবসর জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম হচ্ছে তার একাকিত্ব। এই একাকিত্ব যতোটা না তার বাইরের তার চেয়ে বেশি তার ভিতরের জগতের। পরিবারের সকলের অমনোযোগীতার আড়ালে আস্তে আস্তে বয়স্ক মানুষটির জীবন যে ফুরিয়ে আসে, পরিবারের অনেকেই তা বুঝতে পারে না। তাই পুরো ব্যাপারটিকে শুধু দায়িত্ববোধের দিক থেকে দেখাটা হয়তো ঠিক হবে না। মা বাবার অপরিসীম ভালবাসার নূন্যতম প্রতিদানও যদি কেউ দিতে চান, তাকে ভালোবাসাই দিতে হবে।

happy wheels 2

Comments