মানিকগঞ্জে বায়োচার ব্যবহারে কৃষকদের অভাবনীয় সাফল্য

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥

মানিকগঞ্জের ছোট কুষ্টিয়া গ্রামের আদর্শ কৃষক মো. খোরশেদ। গত মৌসুমে তিনি ৫৬ শতাংশ জমিতে বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও পেঁপে চাষ করেছিলেন। চাষের সময় বেগুনের ২ শতাংশ, বাঁধাকপির এক শতাংশ, ফুলকপির এক শতাংশ এবং পেঁপের এক শতাংশ জমিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন বায়োচার। কৃষক খোরশেদ জানান, বায়োাচার ব্যবহৃত জমিতে সার ও কীটনাশক যেমন খুবই কম লেগেছে তেমনি সেচ ও দিতে হয়েছে আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক। এ থেকে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমেছে তেমনি ফসলও পেয়েছেন আগের তুলনায় বেশি। আগামী মৌসুমে তিনি তার সকল প্রকার ফসলে বায়োচার ব্যবহার করবেন বলে জানিয়েছেন। উপজেলার দশচিড়া গ্রামের কৃষানী ভানু বেগম, তিনি তার বাড়ির উঠানের এক শতাংশ জমিতে ৫টি মাদা তৈরি করে ৪টিতে বায়োচার এবং একটিতে বায়োচার ছাড়া ধুন্দল চাষ করেছেন। চারিপাড়া গ্রামের কৃষাণী বাসনা রানী ১.৫ শতাংশ জমিতে ৫টি মাদা তৈরি করে ৪টিতে বায়োচার এবং একটিতে বায়োচার ছাড়া লাউ চাষ করেছেন, একই গ্রামের শিউলি আক্তার টমেটো, শশা ও সরিষার এক শতাংশ করে জমিতে বায়োচার ব্যবহার করে পূর্বের তুলনায় বেশি ফসল পেয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। আমডালা গ্রামের রেনু দত্ত তাঁর বাড়ির পাশের্^ ৪শতাংশ জমিতে ৬০টি মাদা তৈরি করে ৩০টিতে বায়োচার এবং ৩০টিতে বায়োচার ছাড়া ধুন্দল চাষ করেছেন। এবং শ্রীবাড়িতে অবস্থিত জাহান এ নিজাম বহুমূখী কৃষি খামারের মালিক ২০০টি মাদা তৈরি করে ১০টিতে পরীক্ষামূলকভাবে বায়োচার ব্যবহার করে ধুন্দল চাষ করেছেন। কৃষক ও কৃষাণীগণ জানান, যে অংশে বায়োচার ব্যবহার করেছেন সে অংশের লাউ ও ধুন্দলের সাইজ বড় ও গাছ সবুজ ও তরতাজা হয়ে আছে।

manikganj pic 3 (1)

মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলায় বায়োচার নামক মাটির খাদ্য ব্যবহার করে অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পাচ্ছেন অত্র উপজেলার কৃষক এবং কৃষাণীগণ। বায়োচারে রয়েছে একাধিক গুণাবলী। বায়োচার মাটির জৈব গুনাগুণ বৃদ্ধি করে, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, সারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়, মাটির অম্লত্ব দূর করে, মাটিতে অবস্থানকারী বিভিন্ন অণুজীবকে সক্রিয় করে তোলে। বায়োচার মাটিতে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত কাজ করতে সক্ষম। বায়োচার ব্যবহার করে কৃষক এবং কৃষানীগন আগের তুলনায় এখন কম খরচে বেশী ফসল ঘরে তুলছেন এবং সফলতার মুখ দেখছেন।

manikganj pic 3 (2)

কৃষক এবং কৃষাণীদের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা খ্রিষ্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি)। প্রতিটি কৃষক ও কৃষাণীর ক্ষেতে সিসিডিবি, দশচিড়া এরিয়া অফিসের বায়োচার প্রজেক্ট কর্তৃক বায়োচার প্রদর্শনীর একটি করে সুন্দর সাইনবোর্ড ও দেওয়া হয়েছে। যেখানে মাটিতে জৈব উপাদান থাকার কথা শতকরা ৫ভাগ সেখানে শিবালয়ের ১২জন কৃষকের মাটি পরীক্ষা করে তা পাওয়া গেছে শতকরা এক ভাগ, কোথাও এক ভাগের কম আবার কোথাও একভাগের সামান্য কিছু বেশি (দুই ভাগের কম)। মাটির এই জীর্ণদশা ফিরিয়ে আনতে চিন্তা, চেতনা ও নিরলস পরিশ্রম দ্বারা সিসিডিবির ডেভেলপমেন্ট পলিসি এ্যাডভাইজার এবং বায়োচার প্রজেক্ট এর টিম লিডার এম মাহাবুবুল ইসলাম (কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জুলিয়ান এর সমন্বয়ে) আবিস্কার করেন আখা (কৃষিবান্ধব চুলা) যাতে রান্নার পাশাপাশি উৎপাদিত হয় বায়োচার নামক এই মূল্যবান বস্তু যা পৃথিবীর আর কোন দেশে হয় না।

সিসিডিবি এর মার্কেট ফ্যাসিলিটর আবু সূফিয়ান জানান,পাঁচশত টাকা মূল্যে তারা আগ্রহীদের মাঝে তাদের আখা নামক বিশেষ চুল্লি বিক্রি করেন। আবার যে কোন সময় বিক্রিকৃত আখা তারা ফেরত নেয়। সে ক্ষেত্রে ক্রেতাকা আখার মূল্য ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। এ আখা ব্যবহার করলে শতকরা ৩০ ভাগ জ¦ালানি সাশ্রয়ী হবে ও ৯৫ ভাগ ধোয়ামুক্ত পরিবেশে রান্না করা যাবে। আখার জ¦ালানি হিসেবে ব্যাবহার করতে হবে কাঠ। রান্না শেষে যে কয়লা পাওয়া যাবে সেটি মিহি করে যে উপাদান পাওয়া যাবে সেটিই হবে বিশেষ জাতীয় মাটির খাদ্য। যে খাদ্য মাটিতে ব্যাবহার করলে মাটি গুণাগুণ বৃদ্ধিপাবে ও ফসল উৎপাদন বাড়বে।

manikganj pic 3 (3)

বায়োচার ব্যবহার করে আরও সফলতার দেখা পেয়েছেন উপজেলার দশচিড়া গ্রামের মোজাফফর মোল্লা ও সুশিল কুমার মন্ডল। মোজাফফর মোল্লা তাঁর ২৭ শতাংশ জমির মধ্যে একশতাংশ জমিতে বায়োচার ব্যবহার করে ভুট্টা চাষ করেছেন। মোজাফফর জানান, তিনি বায়োচার ব্যবহৃত এক শতাংশ জমিতে সাধারণভাবে চাষ করে ৩৫ কেজি ভূট্টা পেয়ে থাকেন। অপরদিকে জমি বায়োচার ব্যবহার করলে এর পরিমাণ ৫ কেজি বেড়ে শতাংশে ৪০ কেজিতে দাঁড়ায়। শুশিল কুমার জানান, তিনি বায়োচার ব্যবহৃত অংশে বায়োচার ছাড়া জমির চেয়ে তুলনামূলকভাবে ধান বেশি পেয়েছেন। আখার গুণাবলী সম্পর্কে আমডালা গ্রামের আখা ও বায়োচার ব্যবহারকারী দলের আহ্বায়ক মনখুশি হালদার বলেন, “আখায় তাড়াতাড়ি রান্না হয়, খড়ি কম লাগে, একবার খড়ি সাজিয়ে দিলে রান্না হয়ে যায়, তাপ কম বেশি করা যায়, ধোঁয়া হয়না, হাঁড়ি পাতিল কালি হয় না এবং যে জ¦ালানি পোড়ানো হয় রান্না শেষে তার ৪ ভাগের এক ভাগ বায়োচার পাওয়া যায়।” উক্ত বায়োচার বিক্রি করে তার পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বায়োচার উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী সম্পর্কে সিসিডিবি, দশচিড়া, শিবালয়, বায়োচার প্রজেক্ট এর মার্কেট ফ্যাসিলিটেটর বলেন, “অত্র শিবালয় এলাকায় ৯টি গ্রামের ৩৭টি পরিবার রান্নার পাশাপাশি বায়োচার উৎপাদন করছেন এবং ৩টি নার্সারি, ২টি প্রাইভেট ফার্ম, ৪০জন কৃষাণী ও ৩০জন কৃষক উৎপাদিত বায়োচার ব্যবহার করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও হাজি দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় বায়োচার নিয়ে গবেষণা করছে।

manikganj pic 3 (4)

বায়োচার সম্পর্কে শিবালয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “মাঠ পর্যায়ে বায়োচার ব্যবহার অত্যন্ত স্বার্থক ও সফলভাবে পরীক্ষিত হয়েছে। মাঠ কর্মীদের মাধ্যমে আরও উন্নত পর্যায়ে এর বিস্তৃতি ঘটলে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।”

মাস্ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ হামিদুল ইসলাম জানান, বায়োচার ব্যবহার করলে কৃষকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে সাশ্রয় লাভ করবেন। এ ছাড়া পরিবেশসম্মত এই জৈব সার ব্যবহারের জমির গুণগতমান ও পানির ধারণ ক্ষমতা অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে।

happy wheels 2

Comments