শেকড় ও পাতায় চলে মতিউরের সংসার

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ

রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়ন সংলগ্ন নোন্দাপুর গ্রামে মতিউরের বাস। শেকড় আর পাতায় চলে যার সংসার। ছোটবেলায় অভাবের সংসারে লেখাপড়া করার তেমন একটা সুযোগ হয়নি তাঁর। ষাট বছর আগে গোদাগাড়ী উপজেলার চর বাস্তপুরে আদি বসতি ছিল তাদের। নদী ভাঙনের কারণে সব হারিয়ে চলে আসেন এই গ্রামে। কিন্তু নদী ভাঙনে সবকিছু হারালেও বাবার কবিরাজি শিক্ষাটির কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও শৈশব থেকেই বাবার সেই কবিরাজি শিক্ষা অর্জন করেছেন মতিউর। বাবা আজ বেঁচে নেই কিন্তু বাবার পেশাটি ঠিক শক্তভাবেই আকঁড়ে ধরেছেন তিনি। যা দিয়েই দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৬ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের সকল চাহিদা মিটিয়ে থাকেন।

IMG_20170921_104741

দোকানের উপকরণ হিসেবে যা দেখা যায় গাছের পাতা, শেকড়, ফল ও এলাকার বিল থেকে সংগ্রহ করা জোঁক। তিনি যেসব ঔষধ হিসেবে বিক্রি করেন সেগুলো হচ্ছে- সোনাপাতা, আমলকি, হরতকি, বহেড়া, চিরোতা, শিমুলমুল, ভূইকুমড়া, ধাউতমুল, শংখমুল, শতমুল, ঘৃতকাঞ্চন (এলোভেরা), ইউসুবগুল, ইউসুবগুলের ভূষি, তালমাখনা, কৃঞ্চতিল, কৃঞ্চজিরা, স্বকালোমিশ্রি, শামেলমিশ্রি, নাগেশ্বর, অশ্বগন্ধা, তেতুলবীজ, জামবীজ, বাসক, উলোডকম্বোল, ছোটচন্দ্রা, বড়চন্দ্রা, কালমেঘ, বেলনপাট, হালিমদানা, পাথরকুচি, হিমসাগর, জাফরান, নাগমণি,পঙ্গিরাজ ও জিংসন। এসব দিয়ে কিছু ঔষধ বাড়িতে তৈরি করেন এবং কিছু সরাসরি বিক্রি করে থাকেন।

রাতের শেষে ভোরের সূর্য ফুটলেই প্রস্তুতি শুরু হয় দোকান নিয়ে হাটে যাওয়ার। তাঁর ব্যবসার স্থান হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন হাটগুলো। হাটের ফুটপাতে নির্দিষ্ট একটি স্থানে দোকান মেলে বসেন তিনি। স্থানীয় কাঁকনহাট, গোদাগাড়ী, তানোরের মুন্ডুমালা, গোল্লাপাড়া, কালিগঞ্জ, এমনকি রাজশাহী কোর্ড বাজারেও তিনি দোকান বসিয়ে থাকেন।

IMG_20170921_105045

দোকানে দাঁড়িয়ে একজন গ্রাহকের সাথে দেখা মিলে, তার নাম উমর আলী (৮৩)। তার সাথে আলাপ হলে তিনি বলেন, ‘আমার পেটের সমস্যা হওয়ার ফলে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করলাম। কিন্তু কোন ফল পাইনা। অবশেষে এই দোকান থেকে সোনাপাতা ক্রয় করে ভিজে রেখে প্রতিদিন সেই পানি খাওয়া শুরু করি। বর্তমানে আমার পেটের সমস্যার সমাধান হয়েছে। গাছের ঔষধ ভালো কাজ করে, কিন্তু আমরা সেগুলোকে কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। শুধু তাই নয় আমাদের বাড়িতে এখন গরু ছাগলের জন্যও এসব গাছের ঔষধ আমরা ব্যবহার করি।”

মতিউর এ প্রসঙ্গে বলেন, “সপ্তাহে প্রতিদিন হাট করার কারণে ঔষধি গাছ উৎপাদনে সময় দিতে পারিনা। আমার স্ত্রী বাড়ির আশেপাশে সামান্য পরিমাণে ঔষধি গাছ রোপণ করে আমাকে সহায়তা করে। এছাড়া আমার দোকানের অধিকাংশ গাছ ক্রয় করতে হয়, এজন্য আমার বাড়তি পুঁজিও রাখতে হয়।” তিনি আরও বলেন, “নাটোরের ঔষধি গ্রাম থেকে বেশির ভাগ গাছ, ফল ও শিকড় সংগ্রহ করা হয়। অন্যান্য গাছ, ফল, বীজ ও শেকড়গুলো এলাকার মানুষের কাছ থেকে অল্প দামে সংগ্রহ করি। দোকানে প্রধানত চিরতা, সোনাপাতা ও ইউসুব গুল বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। আমার জানা মতে, এগুলো পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত থেকে এসে থাকে। এ কারণে একটু বেশি দামেই আমাদের কিনতে হয়, ফলে লাভ কম হয়। এসব গাছের ঔষধ এখন গ্রামের চেয়ে শহরে চাহিদা বেড়েছে। এই কারণে বাড়ির পাশে একটি জায়গায় কিছু গাছ সংরক্ষণ করার উদ্যোগও গ্রহণ করেছি আমি।”

IMG_20170921_110513

তার ইচ্ছে সম্পর্কে জানান, এই দোকান থেকে প্রতি মাসে প্রায় পনের হাজার টাকা রোজগার হয়। তাই দিয়েই কোন মতে সংসার চলে। তিনি বলেন, “এই এলাকায় আমার মতো আরও একজন রাজশাহী বানেশ্বরের আব্দুল আওয়াল ভাই একই ধরনের দোকান করেন। তার দোকানটিতে অনেক ধরনের ঔষধি গাছ থাকে। কিছু পুঁজি সংগ্রহ করে তার মতো একটি সমৃদ্ধশালী দোকান করাই আমার ইচ্ছে।”

চিরতা, সোনাপাতা, ইউসুব গুলসহ অতি প্রয়োজনীয় কিছু গাছ আমাদের বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এসব গাছের বীজ সংগ্রহ করে আমাদের দেশের মাটিতে পরীক্ষামুলক চাষ করা যেতে পারে। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক ঔষধি গাছ বৈচিত্র্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি উৎপাদনকারীদের সাথে প্রক্রিয়াজাত ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ে করা উচিত। তবেই ঔষধি গাছের সহজলভ্যতা বাড়বে। এভাবেই ঔষধি গাছের ব্যবহারে এক সম্ভবনার দ্বার উম্মোচন হবে বলে তিনি মনে করেন।

happy wheels 2

Comments