বাহারি রঙের অতিথি পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলা যেন পটে আঁকা ছবি

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥

শান্ত জলের বুকে লাল শাপলার গালিচার মাঝে ঝাঁক বেঁধে ডানা মেলছে অতিথি পাখির দল। উড়ে চলা পাখির কিচির-মিচিরে মুখরিত চারিপাশ। বাহারি রঙের এসব অতিথি পাখির খুনসুঁটি আর ছুটাছুটি যে কারো মনেক উদ্বেলিত করে তুলে। শীতের মৌসুমে প্রকৃতির অপরূপ অলঙ্কার হয়ে ওঠা এ অতিথি পাখির ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলার দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন জলরঙে আঁকা ছবি।

প্রতিবছর শীতকাল এলেই জলাশয়, বিল, হাওড়, পুকুর ভরে যায় নানা রংবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। মূলত এই অতিথি পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজেদের জীবন বাঁচাতে। অতিথি পাখি দেখতে যেতে চান? সাথে দিগন্ত বিস্তৃৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে রাজ্য? তাহলে এই জায়গাটি আপনারই জন্য! বলছি নিলুয়ার বিলের কথা। মানিকগঞ্জের ঘিওর, দৌলতপুর এবং টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার দক্ষিণাংশের মানুষজন ব্যতিত বেশিরভাগ লোকজনই বিলটির কথা জানে না। বিলটির অবস্থান মানিকগঞ্জের দুই উপজেলা ঘিওর এবং দৌলতপুরের ঠিক মাঝখানে। পাশ দিয়েই চলে গেছে আরিচা-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়ক।

01

মানিকগঞ্জের এই নিলুয়ার বিলে অতিথি পাখির আনাগোনা বেড়েছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। প্রতিবছর শীত মৌসুমে বিলটি যেন হয়ে যায় পাখির আবাসস্থল। এবারও এ বিলে আবাস বেঁধেছে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখিসহ হাজারো অতিথি পাখি। নিলুয়ার বিলে পাখি থাকে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখির কলতান মুগ্ধ করে সবাইকে। দলবেঁধে যখন পাখিগুলো আকাশে ওড়ে, তার সঙ্গে যেন উড়ে চলে মনও। পুরো এলাকাটিই সরব করে রাখে এই পাখপাখালি। পাখিদের এই মিছিলে আছে দেশীয় বক, বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, পানি কাউর, পানকৌড়িসহ নাম না জানা অনেক অতিথি পাখি।

শীতের আবেশে মানিকগঞ্জের পদ্মা ও যমুনা নদীর চরকে ঘিরে বেড়েছে অতিথি পাখির কলরব। তিব্বতীয় মানিকচক, সাইবেরিয়ান ফিদ্দাসহ দেখা মিলছে বিলুপ্ত নানা প্রজাতির পাখিও। বন বিভাগ বলছে, পরিবেশগত উন্নতি ও খাবারের প্রাচুর্যই বাড়িয়েছে পাখিদের বিচরণ। এছাড়াও মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আন্ধারমানিক, সূতালড়িসহ আশপাশ এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পাড়ে এবং দৌলতপুর উপজেলার যমুনা নদীর ৩/৪ টি পয়েন্টে হাজারো অতিথি পাখির দেখা মিলে। নদীর স্তব্ধ জলে পড়ন্ত বিকেলে শত শত মানুষ নৈস্বর্গিক এ দৃশ্য উপভোগ করেন।

02

এদিকে অতিথি পাখির মেলাখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জলাশয় পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে শীতের শুরু থেকেই। গাছপালায় ঢাকা সবুজ এ ক্যাম্পাসের বুকে আছে বেশ কয়েকটি জলাশয়। বেশ কয়েকবছর ধরে এ জলাশয়গুলোকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে শীতের অতিথি পাখিরা।

বর্তমানে ক্যাম্পাসের জলাশয়ে ‘পাতি সরালি’র সংখ্যাই চোখে পড়ছে বেশি। এছাড়া মাঝে মাঝে দেখা মিলে পানকৌড়ি, ধলাবুক ডাহুকের। তবে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়গুলোতে পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি সাধারণত বেড়ে থাকে। মূলত নভেম্বর মাসেই অতিথি পাখিরা বাংলাদেশে আসে। আবার মার্চের শেষ দিকে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের জরিপ বলছে, ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অতিথি পাখি আসে। এ সময় ৯০ প্রজাতির অতিথি পাখি দেখা যায়। বর্তমানে এ ক্যাম্পাসে ১৯৫ প্রজাতির পাখি আছে। যার মধ্যে ১২৬টি প্রজাতি দেশীয় এবং ৬৯টি অতিথি পাখি। এবার জাবির এ আঙ্গিনায় দুই ধরনের পাখির সমাগম ঘটেছে। এক ধরনের পাখি ডাঙায় বা শুকনো স্থানে থাকে। ক্যাম্পাসে ছোট-বড় ১৩-১৪টি লেক থাকলেও এখন পর্যন্ত চারটি লেকে অতিথি পাখি বসেছে। প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের লেক।

04

পাখি গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘অতিথি পাখিরা এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নিরাপদ মনে করে। এসব পাখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সচেতনতার মাধ্যমে পাখিদের নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ বসবাসের উপযোগী হওয়ায় সুদূর সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট সময়ে পাখিরা দল বেঁধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। সাধারণত খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকায় এবং শিকারীর উপদ্রব না থাকায় এখানে পাখিরা ভিড় জমায়।

পাখি বিষয়ক দেশে সাড়া জাগানো একটি অনলাইন গ্রুপের হেড অব এডমিন আব্দুল হান্নান দিনার জানান, সাধারণত হিমালয়ের উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে এ সময়টায় প্রচুর তুষারপাত হয়। এ তুষারপাতে পাখিরা টিকতে না পেরে বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। শীত চলে গেলে তারাও চলে যাবে তাদের আপন ঠিকানায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নোমান জানান, ক্যাম্পাসের জলাশয় পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে শীতের শুরু থেকেই। শীতের এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারের প্রচন্ড অভাব দেখা দেয়। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যের নিচের কোঠায়। সেই সাথে তুষারপাতের ফলে কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না। তাই পাখিরা দেশান্তরী হয়ে চলে আসে আমাদের দেশে।

পাখি বিষয়ক বিভিন্ন জার্নাল মারফত জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। কিছু কিছু পাখি তাই প্রতিবছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে যায় দূরদেশে। উত্তর মেরু অঞ্চলের এক জাতীয় সামুদ্রিক শঙ্খচিল প্রতিবছর এই দূরত্ব অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে চলে আসে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফ শুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশির ভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখিরা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। এ ছাড়া ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য (যেমন সাইবেরিয়া) থেকেও এসব পাখি আসে।

05

মজার একটা ব্যাপার হলো, নির্দিষ্ট সময় পরে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়। এ বিষয়ে পাখি বিষয়ক একাধিক গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে; এই পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই সৃষ্টিকর্তা দিয়ে দিয়েছেন। যা তাদের পথ চলার সময় দিক নির্দেশনায় সহায়তা করে। তাছাড়া তারা সূর্য ও তারার অবস্থানের উপরই নির্ভর করে পাখিরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ রয়েছে।

এসব পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এছাড়া স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, বালি হাঁস, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া প্রভৃতি।

বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, “অতিথি পাখিদের বিচরণ নিরাপদ করার জন্য অতিথি পাখি, বক, ঘুঘু বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাখি শিকার ও বিক্রয় বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার পাশাপাশি পরিকল্পিত বনায়ন, জলাভূমি ও জলাশয়গুলো সংস্কার করে অতিথি পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই দিন দিন আমাদের দেশে অতিথি পাখিদের ভীড় বৃদ্ধি পাবে।”

ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রাম ও শহরের সব বয়সী মানুষজন মুগ্ধতার আবেশে দেখছে জলাশয় ও অতিথি পাখির যোগসূত্রের এই নৈসর্গিক দৃশ্য। আমাদের চিত্তানন্দের উপাদান এই পাখিরা কিন্তু জীবন ও জীবিকার আশায় হাজার-অযুত পথ পাড়ি দিয়ে দিনের পরে রাত উড়ে উড়ে আসে আমাদের দেশে, আর এত পথ পাড়ি দিয়েও শেষ রক্ষা হয়না, আমাদের একটু বেআইনী ক্ষুদ্র আনন্দের শিকার হয়ে ওদের প্রাণ দিতে হয় ! পাখি শিকার বন্ধ করে আমরা কি এই অতিথিদের প্রতি আরো একটু সদয় আর আরো একটু ভালোবাসার পরিচয় দিতে পারিনা ?

happy wheels 2

Comments