কার্বন নিঃসরণ রোধে সহায়ক পরিবেশসম্মত মাটির চুলা

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং ও খাদিজা আক্তার লিটা

গ্রামীণ নারীদের প্রতিদিনের বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় দৈনন্দিন জ্বালানি সংগ্রহের জন্য, বিশেষভাবে লাকড়ি, শুকনা পাতা, খড়, ঘুটে তৈরি ইত্যাদি জ্বালানি সংগ্রহে। মাটির উন্নত চুলা উদ্ভাবনে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তেমন কোন উদ্যোগ না থাকায় এবং প্রচলিত চুলা ব্যবহারের ফলে জ্বালানির পরিমান যেমন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তেমনি গ্রামীণ নারী জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সকল গ্রামে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না থাকায় এবং কোন কোন গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও অধিক খরচ হওয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এসব জ্বালানি ব্যবহার করতে পারছেনা।

20171129_112925-W600
জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব চুলা উদ্ভাবনে গ্রামীণ নারীদের উদ্বুদ্ধকরণে নেত্রকোনা পৌরসভাধীন মইনপুর গ্রামে বারসিক ও এলাকার জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে ‘কার্বন নিঃসরণ রোধ করি, নির্মল পরিবেশ গড়ি’ স্লোগানকে সামনে রেখে দিনব্যাপী এক চুলা তৈরি প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। প্রতিযোগিতায় মইনপুর গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম কলোনীপাড়ার প্রায় ৪৮ জন নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল- জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব মাটির চুলা উদ্ভাবনের মাধ্যমে রান্নার ফলে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ হ্রাস করা। প্রতিযোগিতায় উদ্ভাবিত জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব চুলা বিষয়ে প্রচারণার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে চুলা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা।

20171129_113532-W600
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে ছিল- জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব চুলা বিষয়ে আলোচনা, চুলা প্রদর্শনী ও ঘরে ঘরে গিয়ে চুলাগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে ও রান্না করে (চা তৈরি ও পানি সেদ্ধ করে) ধোঁয়ার পরিমাণ, জ্বালানির পরিমাণ ও রান্নার সময় পর্যবেক্ষণ করা।

প্রতিযোগিতায় ১২ জন নারী তাদের তৈরি করা ৯ ধরনের বহনযোগ্য মাটির চুলা প্রদর্শন করেন। প্রদর্শিত মাটির চুলাগুলো ছিল: হিটার চুলা (বৈদ্যুতিক কয়েল দিয়ে ব্যবহার করা হয়), নৌকা চুলা, তোলা চুলা, ফাঁসিকাটা চুলা, গোলমূখী চুলা, চারকোনা চুলা, সিঙ্গারা চুলা, ডেকচি চুলা ও ঝিনুক চুলা। চুলা প্রদর্শনির পাশাপাশি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বারসিক’র প্রতিনিধি শংকর ¤্রং ও খাদিজা আক্তার প্রতিযোগিতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে হেলেনা আক্তার, শিউলি, ঝর্ণা, মাজেদা ও খোদেজা বৈচিত্র্যময় চুলা তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। কৃষাণী হেলেনা আক্তার বলেন,“মইনপাড়া গ্রামটি নেত্রকোনা পৌরসভাধীন হলেও মগড়া নদী দ্বারা গ্রামটি মূল পৌরসভা থেকে বিচ্ছিন্ন, ফলে গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও গ্যাস সংযোগ নাই। ফলে রান্নার জন্য নারীদেরকে প্রচলিত চুলা ও জ্বালানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। গ্রামের নারীদের রান্নার মূল জ্বালানির উৎস হল লাকড়ী, গাছের পাতা, খড়, গুটে, তুষ ও কাঠের গুড়া।” তিনি আরও বলেন, “এসব জ্বালানি দিয়ে প্রচলিত চুলায় রান্নার ফলে প্রচুর ধোঁয়া হয় এবং জ্বালানিও বেশি লাগে, ফলে জ্বালানি খরচ বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক ধোয়ার ফলে নারী ও শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। ঘরের আসবাবপত্র চাল কালো হয়ে ব্যবহার অনুপযোগি হয়ে পড়ছে, ঘরের চাল হারাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ীত্ব।”

20171129_115042-2-W600
গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও মারাত্বক লোডশেডিং ও বৈদ্যুত্যিক চুলার দাম বেশি হওয়ায় এবং রান্নার কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারে বিল বেশি হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও তারা বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করতে পারছেন না বলে হেলেনা আক্তার জানায়।

বারসিক প্রতিনিধি শংকর ¤্রং বলেন, ‘সাধারণ চুলায় রান্নার জন্য লাকড়ি, শুকনা পাত, খড়, ঘুটে, তুষ, কাঠের গুড়া ইত্যাদি জ্বালানি ব্যবহারের ফলে প্রচুর কার্বন (ধোয়া) নির্গত হয়, যা বায়ুমন্ডলে সিএফসি গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। ফলে ওজন স্তর দিন দিন ক্ষয় হচ্ছে, যা পৃথিবীর জন্য তথা প্রাণীকূলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।” তিনি জানান, এসব জ্বালানি সাধারণ চুলায় ব্যাহারের ফলে নির্গত কালো ধোঁয়া নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গ্রামীণ নারী ও শিশুরা এসব জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন-চোখের বিভিন্ন সমস্যা, চুলকানি, শ্বাস কষ্ট ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও লাকড়ির চাহিদা পূরণে পরিবেশের প্রধান উপাদান গাছ কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। আর এর ফলে জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষসহ সকল প্রাণীকূল ও প্রকৃতির উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যেমন- খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, নতুন নতুন ফসলের রোগ-বালাই ইত্যাদি।

20171129_122328-W600
শংকর ¤্রং আরও জানান, উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ কয়লার বেশিরভাগ অংশই ব্যয় হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে গ্যাস ও কয়লার মজুদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ১৫/১৬ বছর পর দেশে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে, নগরবাসী মারাত্মক জ্বালানি সংকটের সন্মূখীন হবে। তিনি বলেন, “আমাদের সকলকে সকল প্রকার জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, এসি ব্যবহার না করা এবং গ্যাসের বা লাকড়ির চুলা জ্বালিয়ে না রাখা। গ্রামাঞ্চলে রান্নার জন্য জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব চুলা উদ্ভাবন করে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।”

20171129_133209-W600
আলোচনা শেষে ১২ জন অংশগ্রহণকারীর ঘরে ঘরে গিয়ে ৯ ধরনের চুলায় আগুন জ্বালিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে জ্বালানি সাশ্রয়ী, কম ধোঁয়া হয়, পরিবেশবান্ধব ও সব ধরণের (গ্যাস ও বিদ্যুৎ বর্হিভূত) জ্বালানি ব্যবহার করা যায় এবং সময় সাশ্রয়ী এমন চুলা নির্বাচন করা হয়। সরেজমিনে চুলা পরীক্ষা করে সকলের মতামতের ভিত্তিতে নৌকা চুলা, গোলমূখী চুলা ও ডেকচি চুলাকে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে নির্বাচন করা হয়। যেহেতু ১২ জন প্রতিযোগিই একাধিক প্রকারের চুলা তৈরি করেছেন তাই প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত করার জন্য তিনজনকে নির্বাচন করা হয় মূলতঃ ধোঁয়া কম হয়, রান্নায় সময় কম লাগে, একসাথে অনেক লোকের রান্না করা যায়, সহজে বহনযোগ্য, জ্বালানি সাশ্রয়ী, সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা যায়, রান্না বসিয়ে অন্যান্য কাজ করা যায়, অন্যদেরকে চুলা তৈরি করে দিয়ে বা তৈরিতে সহযোগিতা করা ইত্যাদি দিক বিবেচনায়। প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচিত হয় যথাক্রমে কৃষাণী হেলেনা আক্তার, মাজেদা খাতুন ও জ্যোৎস্ন বেগম।

প্রথম স্থান অধিকারী হেলেনা আক্তার বিগত বছরে প্রায় ১২০ জন গ্রামীণ নারীকে বিনা পারিশ্রমিকে নৌকা চুলা ও গোলমূখী চুলা তৈরি করে এবং চুলা তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। তার উদ্ভাবিত নৌকা চুলাটি জ্বালানি সাশ্রয়ী, রান্নায় কম সময় লাগে, ধোঁয়া খুবই কম হয়, রান্নায় বসিয়ে অন্যান্য কাজ করা যায়, সহজে বহনযোগ্য এবং এক সাথে অনেক লোকের রান্না করা যায়।

IMG_20171129_120434-W600
দ্বিতীয় স্থান অধিকারী মাজেদা খাতুন বিগত বছর প্রায় ৯০ জনকে চুলা তৈরি করে দিয়ে ও চুলা তৈরিতে সহযোগিতা দিয়েছেন। তার উদ্ভাবিত নৌকা চুলা ও চারমূখী চুলা জ্বালানি সাশ্রয়ী, কম ধোঁয়া হয়, রান্নায় সময় কম লাগে, এক বা একাধিক ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন ধরণের চুলা, সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহার উপযোগি, সহজে বহনযোগ্য।

তৃতীয় স্থান অধিকারী জ্যোৎস্না বেগম বিগত বছর অন্য কাউকে চুলা তৈরি করে দেয়নি। তবে তিনি পাঁচ ধরনের চুলা তৈরি করেছেন, যার মধ্যে তিনটি চুলা (নৌকা চুলা, তিনমূখী চুলা ও ঝিনুক চুলা) অপেক্ষাকৃত জ্বালানি সাশ্রয়ী, কম ধোঁয়া হয়, রান্নায় সময় কম লাগে, সহজে বহনযোগ্য এবং দেখতে সুন্দর।
অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ী প্রতিযোগিরা পরস্পর পরস্পরের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন। অন্যান্য প্রতিযোগিদেরকে সান্তনা পুরষ্কার দেয়া হয়। অংশগ্রহণকারীরা আগামীতে ব্যাপকভাবে এবং আরও নতুন ধরণের পরিবেশবান্ধব চুলা উদ্ভাবনের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

IMG_20171129_122342-W600
চুলা তৈরি প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও স্বাস্থ্যসম্মত মাটির তৈরি চুলা নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। এসব চুলা প্রত্যেক গ্রামে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব হবে। জ্বালানি বাবদ খরচ সাশ্রয় হবে, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে। রান্না বসিয়ে নারীরা সংসারের অন্যান্য কাজ করতে পারবে এবং রান্না বাবদ সময় সাশ্রয় হবে।

happy wheels 2

Comments